আমি দাদাজানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী জন্যে এত বড় পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন? দাদাজান বললেন, ফরগেট ইট! এই বাক্যটি তাঁর খুব প্রিয়। কারণে-অকারণে তিনি বলেন, ফরগেট ইট! যেসব প্রশ্নের উত্তরে ‘ফরগেট ইট’ কিছুতেই বলা যায় না, সেখানেও তিনি এই বাক্য বলেন। উদাহরণ দেই—
আমি একদিন বললাম, দাদাজান, বাজার থেকে মাগুর মাছ এনেছে। মটরশুটি দিয়ে রান্না করবে, নাকি আলু দিয়ে?
দাদাজান বললেন, ফরগেট ইট!
আমি বললাম, কী ফরগেট করব? মাছ রান্না?
তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আমাকে বিরক্ত করবি না।
রান্না তুচ্ছ বিষয়?
স্টপ আর্গুইং।
তুচ্ছ বিষয় নিয়ে দাদাজান কথা বলতে পছন্দ করেন না, এই তথ্য পুরোপুরি মিথ্যা। তার আগ্রহ তুচ্ছ বিষয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন।
১৯৭১ সালের মে মাসে দাদাজান আমার জন্যে গোলাপি রঙের বোরকা কিনে আনলেন। কঠিন বোরকা। বাইরে থেকে চোখও দেখা যায় না এমন। চোখের ওপর মশারির মতো জাল। এখানেই শেষ না, বোরকার সঙ্গে কালো হাতমোজা। পায়ের মোজা। দাদাজান আমাকে বললেন, না আমেন্ট, নো তর্ক, নো ডিলে। বোরকা পর। আমি বোরকা পরলাম। দাদাজান বললেন, এখন চল।
আমি বললাম, কোথায় যাব?
সোহাগী যাব। ঢাকা শহরে থাকা যাবে না। মিলিটারি মেরে ফেলবে। এখনই রওনা হব।
সঙ্গে আর কিছু নেব না? দাদাজান বললেন, ফরগেট ইট! আমি বললাম, দাঁত মাজার ব্রাশও নেব না?
দাদাজান বললেন, বেঁচে থাকলে দাঁত মাজার অনেক সুযোগ পাবি। বেঁচে থাকবি কি না এটাই এখন প্রশ্ন।
ঢাকা শহর আমরা পার হলাম রিকশায় এবং পায়ে হেঁটে। কিছু কিছু বাস ঢাকা থেকে যাচ্ছিল। ঢাকা ছেড়ে যাওয়া বাসগুলিতে মিলিটারিরা ব্যাপক তল্লাশি চালাচ্ছিল। মিলিটারি তল্লাশি মানে কয়েকজনের মৃত্যু। রূপবতী মেয়েদের ধরে আড়ালে নিয়ে যাওয়া তখনো শুরু হয় নি।
ঢাকা থেকে পালানোর সময় রিকশা ছাড়া আর যেসব যানবাহনে আমি চড়েছি সেগুলি হচ্ছে মহিষের গাড়ি, মোটরসাইকেল (শিবগঞ্জ থানার ওসি সাহেব মোটরসাইকেল চালিয়েছেন, তার পেছনে দাদাজান ও আমি বসেছি।) সবশেষে নৌকা। নৌকাও কয়েক ধরনের। এর মধ্যে একটা ছিল বালিটানা নৌকা। এই নৌকায় পাটাতনের নিচে আমাকে দাদাজান লুকিয়ে রাখলেন। যাত্রার পুরো সময়টা তিনি আতঙ্কে অস্থির হয়ে ছিলেন। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন আমরা একপর্যায়ে মিলিটারির হাতে পড়ব। তারা দাদাজানকে গুলি করে মারবে এবং আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। সেই সময় দাদাজান দিনের মধ্যে অনেকবার অজু করতেন। তিনি চাচ্ছিলেন যেন পবিত্র অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
আমরা তিন দিন পর আধামরা অবস্থায় সোহাগী পৌঁছালাম। দাদাজানের বাড়ি সোহাগীতে। বাড়ির নাম ‘রঙমহল’। শ্বেতপাথরে কালো রঙ দিয়ে লেখা। ‘র’-এর ফোঁটা উঠে যাওয়ায় এখন নাম হয়েছে বঙমহল। নদীর পাড়ে দোতলা দালান। বাবার সঙ্গে এই বাড়িতে আগে আমি দু’বার এসেছি। কিছু কিছু বাড়ি থাকে সাধারণ, সেই সাধারণে লুকিয়ে থাকে অসাধারণ। ‘বঙমহল’ সেরকম একটি বাড়ি। এই বাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।
দাদাজানের এই বাড়ি পুরোনো। দোতলায় টানা বারান্দা আছে। স্টিমারের ডেকে বসলে যেমন সারাক্ষণ প্রবল হাওয়া গায়ে লাগে, বারান্দায় দাঁড়ালেও তা-ই। সারাক্ষণ হাওয়া বইছে। বাড়ির তিনদিকেই ফলের বাগান। লিচুগাছ থেকে শুরু করে তেঁতুলগাছ, সবই সেখানে আছে। দাদাজানের ওই বাড়িতেই আমি জীবনে প্রথম গাছ থেকে নিজ হাতে পেড়ে লিচু খেয়েছি। লিচু মিষ্টি না, টক। লবণ দিয়ে খেতে হয়।
আমাদের বাড়ির সামনের নদীর নাম তরাই। এই নদী ব্রহ্মপুত্রের শাখা। বর্ষায় পানি হয়। শীতের সময় পায়ের পাতা ভেজার মতো পানি থাকে। সেবার তরাই নদীতে প্রচুর পানি ছিল। জেলেরা সারা দিনই জাল ফেলে মাছ ধরত। তরাই নদীর বোয়াল মাছ অত্যন্ত সুস্বাদু। জেলেরা ভোরবেলায় মাছ দিয়ে যেত। নানান ধরনের মাছ। কৈ, সরপুঁটি, ট্যাংরা, খইলসা। মাঝে মাঝে মাঝারি সাইজের কাতল। সেবারই আমি কাতল মাছের আস্ত মাথা খাওয়া শিখি। রান্না করতেন ধীরেন কাকু। উনি হিন্দু ব্রাহ্মণ। দাদার বাড়ির আশপাশে প্রচুর আত্মীয়স্বজন থাকার কথা। তা ছিল না। কারণ দাদাজানের বাবা (খালেক মুনশি) পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক দূরে এই বাড়ি করেছিলেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে তার উপায় ছিল না। তিনি তাঁর বড়ভাইয়ের স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন। ওই মহিলার ছবি আমি দেখেছি। তিনি ছিলেন কদাকার। উঁচু হনু। দাঁত বের হওয়া। গায়ের রঙ পাতিলের তলার মতো কালো। কী দেখে তিনি এই মহিলার প্রেমে পড়েছিলেন তা এখন আর জানার উপায় নেই।
দাদাজানের বাড়িতে কেয়ারটেকার সেন কাকা ছাড়াও ছিলেন ধীরেন কাকার স্ত্রী রাধা। উনি রূপবতী ছিলেন। আমি লক্ষ করেছি, রাধা নামের সব মেয়েই রূপবতী হয়। রাধা কাকি সারাক্ষণই বাড়ি পরিষ্কার রাখার কাজকর্ম নিয়ে থাকতেন। এই দুজন ছাড়াও দবির নামের মধ্যবয়স্ক একজন ছিলেন, যার কাজ গাছপালা দেখা, বাগান করা।
বঙমহলে আমার সময় খুব ভালো কাটছিল। আমি বাগানে দবির চাচাকে দিয়ে দোলনা টানিয়েছিলাম। দোলনায় দুলতে দুলতে গল্পের বই পড়তাম। দাদাজানের লাইব্রেরিতে চামড়ায় বাঁধানো অনেক বই ছিল। বেশির ভাগই গ্রন্থাবলি। রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি উপন্যাস আমি দাদাজানের বাগানের দোলনায় দুলতে দুলতে পড়েছি।