শফিক বলল, যাব।
কাদের বলল, আপনের সঙ্গে আমি ভাই পাতাইলাম। আইজ থাইকা আপনে আমার ছোটভাই। আমি খুবই গরিব মানুষ। ভাইয়ে-ভাইয়ে আবার ধনী-গরিব কী? ঠিক না ছোটভাই?
শফিক হাসল।
সরফরাজ খান একদৃষ্টিতে তার হাতের কাগজের দিকে তাকিয়ে আছেন। কাগজে পেন্সিলে এক পরী আঁকা হয়েছে। পরীর নাম অবন্তি। পেন্সিলে আঁকা একটা ছবি এত সুন্দর হয়! তাও সম্ভব। অবন্তিকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! দুষ্টুমি করে সে নিচের ঠোঁট সামান্য বাঁকা করে রেখেছে। তাও বোঝা যাচ্ছে।
যে মাস্টার এত সুন্দর ছবি আঁকে সে শয়তানের ঘনিষ্ঠ স্বজন ছাড়া কিছু না। ছবি আঁকা বিদ্যা দিয়ে সে নিশ্চয়ই মেয়েদের ভুলায়, এটা বোঝাই যাচ্ছে। মেয়েদের স্বভাবই হচ্ছে হালকা জিনিস নিয়ে মাতামাতি করা। যে ছবি ক্যামেরায় তোলা যায় সেই ছবি পেন্সিলে আঁকার কিছু নেই। বদের হাড্ডি।
সরফরাজ খান সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন—মাস্টারের চাকরি শেষ। পত্রপাঠ বিদায়। ছবিটাও নষ্ট করে ফেলতে হবে।
অবন্তি তার দাদাজানের পাশে এসে দাঁড়াল। সরফরাজ খান ছবি নামিয়ে রাখলেন। অবন্তি বলল, টাসকি খেয়েছ দাদাজান?
টাসকি আবার কী?
টাসকি হচ্ছে কোনো-একটা জিনিস দেখে ঘাবড়ে যাওয়া। তুমি কি ছবি দেখে টাসকি খেয়েছ?
টাসকি খাওয়ার মতো কোনো ছবি না।
দাদাজান, তুমি হিংসা করছ।
আমি হিংসা করছি? গরুর নাদিকে আমি হিংসা করব?
গরুর নাদি বলছ কেন?
যে যা আমি তাকে তা-ই বলি।
আমার স্যার গরুর নাদি?
ইয়েস।
চিন্তাভাবনা করে বলছ, নাকি আমাকে রাগানোর জন্যে বলছ?
চিন্তাভাবনা করেই বলছি।
দাদাজান শোনো। আমি তোমার সঙ্গে বাস করব না।
কোথায় যাবে?
আমি আমার স্বামীর কাছে চলে যাব।
কার কাছে চলে যাবি?
স্বামীর কাছে। To my beloved husband,
সরফরাজ খান কঠিন চোখে অবন্তির দিকে তাকিয়ে আছেন। অবন্তিও তাকিয়ে আছে, তবে অবন্তির মুখ হাসি হাসি।
সরফরাজ উঠে দাঁড়ালেন। অবন্তি বলল, কোথায় যাচ্ছ?
সরফরাজ বললেন, ঘুমাতে যাচ্ছি। আর কোথায় যাব
আমার ছবি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছ কেন? ছবি রেখে যাও। এই ছবি আমি বাধিয়ে আমার শোবার ঘরে রেখে দেব।
সরফরাজ খান বিরক্ত গলায় বললেন, বাড়াবাড়ি করিস না। কোনোকিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি করা ঠিক না।
অবন্তি বলল, এই কথা তোমার জন্যেও প্রযোজ্য। তুমিও কোনোকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না।
সরফরাজ বিছানায় শুয়েছেন। তার হাতে ইছামতি বই। বইটা পড়ে কোনো আরামই পাচ্ছেন না। জটিল ভাষা। অর্থহীন কথাবার্তা। তারপরেও বই শেষ করতে হবে। নিশ্চয়ই বইয়ের কোথাও-না-কোথাও বদ মাস্টার কোনো ইশারা দিয়েছে। পেন্সিল দিয়ে আন্ডারলাইন করেছে।
সরফরাজ ইছামতি পড়ছেন—
রাজারামের ভগ্নি তিনটির বয়স যথাক্রমে ত্রিশ, সাতাশ ও পঁচিশ। তিলুর বয়স সবচেয়ে বেশি বটে, কিন্তু তিন ভগ্নির মধ্যে সে-ই সবচেয়ে দেখতে ভালো, এমনকি তাকে সুন্দরী শ্রেণীর মধ্যে সহজেই ফেলা যায়। তিলুর মধ্যে পাকা সবরি কলার মতো একটু লালচে ছোপ থাকায় উনুনের তাতে কিংবা গরম রৌদ্রে মুখ রাঙা হয়ে উঠলে বড় সুন্দর দেখায় ওকে। তন্বী, সুঠাম, সুকেশী—বড় বড় চোখ, চমৎকার হাসি। তিলুর দিকে একবার চাইলে হঠাৎ চোখ ফেরানো যায় না। সরফরাজ বই বন্ধ করলেন। মাস্টারের ব্যাপারটা এখন বোঝা যাচ্ছে। অবন্তি হচ্ছে তার তিলু। আরও কিছুদূর এগুলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। দেখা যাবে তিলু প্রেমে পড়েছে তার গৃহশিক্ষকের। এই গৃহশিক্ষক আবার পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে পারে। সরফরাজ মনে মনে বললেন, হারামজাদা! ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখো নি। তুমি আমাকে চেনো না। আমি সরফরাজ খান। দাঁড়াও, তোমার শিক্ষাসফরের ব্যবস্থা করছি, বইটা আগে শেষ করি।
সরফরাজ পাঠে মন দিলেন–
তবে তিলু শান্ত পল্লীবালিকা, ওর চোখে যৌবন চঞ্চল কটাক্ষ নেই, বিয়ে হলে এতদিন ছেলেমেয়ের মা ত্রিশ বছরের অর্ধপ্রৌঢ়া গিন্নি হয়ে যেত তিলু। বিয়ে না হওয়ার দরুণ ওদের তিন বোনই মনেপ্রাণে এখনো সরলা বালিকা। আদরে আবদারে, কথাবার্তায়, ধরন ধারণে সব রকমেই।
দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। হাতের বই নামিয়ে সরফরাজ বললেন, কে?
অবন্তি বলল, তোমার জন্যে পান আর চা নিয়ে এসেছি।
সরফরাজ বললেন, ফরগেট ইট!
অবন্তি বলল, দরজাটা খোলো। তোমার টেবিলে রেখে যাই, তারপর তুমি ফরগেট ইট’ করে ফেলবে।
সরফরাজ দরজা খুললেন। অবন্তি পান আর চা নামিয়ে রেখে মিষ্টি করে হাসল। সরফরাজ বিরক্ত মুখে বললেন, হাসছিস কেন? হাসি বন্ধ।
অবন্তি বলল, তোমার হাসতে ইচ্ছা না করলে হাসবে না। তবে আমার এই হেসে যাওয়াতেই আনন্দ।
কী বললি?
বললাম, আমার হেসে যাওয়াতেই আনন্দ।
এর মানে কী?
অবন্তি বলল, খুব সহজ মানে দাদাজান। কেউ হেসে আনন্দ পায়। কেউ কেঁদে আনন্দ পায়। আনন্দটাই প্রধান। হাসা বা কাঁদাটা কোনো ব্যাপার না।
সরফরাজ বললেন, সারাক্ষণ এমন উদ্ভট কথা কেন বলিস?
অবন্তি বলল, আমার এই উদ্ভট কথাতেই আনন্দ।
রাগ করতে গিয়েও সরফরাজ খান রাগ করতে পারলেন না। হেসে ফেললেন।
অবন্তি বলল, দাদাজান, তুমি যখন হাসো তখন তোমাকে কী সুন্দর যে লাগে! অথচ তুমি সারাক্ষণ মুখটাকে রামগরুড়ের ছানা করে রাখো।
রামগরুড়ের ছানা আবার কী?
অবন্তি বলল, যাদের হাসতে মানা, তারাই রামগরুড়ের ছানা। দাদাজান, গুড নাইট স্লিপ টাইট।
অবন্তির লেখা
অবন্তির লেখা
আমার দাদাজান সরফরাজ খান পুলিশের এসপি হয়ে রিটায়ার করেছিলেন। আমি আমার জীবনে তার মতো ভীতু মানুষ দেখি নি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তিনি অসীম সাহসিকতার জন্য পিপিএম’ পেয়েছিলেন। পিপিএম হলো পাকিস্তান পুলিশ মেডেল। পুলিশ সার্ভিসে সাহসিকতার সর্বোচ্চ পুরস্কার।