রানুর মামা ইসমাইল সাহেব, রানুকে দেখে খুবই অবাক হলেন। দীর্ঘ দিন পর সে বাড়িতে এল। ইসমাইল সাহেব বারান্দায় ইজি চেয়ারে শুয়ে ছিলেন। তিনি উঠে বসতে চেষ্টা করলেন, পারলেন না। এখন প্রায় অথর্ব অবস্থায এসে পৌঁছেছেন। নিজে নিজেই কিছুই প্ৰায্য করতে পারেন না।
কেমন আছ মামা?
ভাল আছি। বেশ ভাল। তুই কী মনে করে?
দেখতে এলাম। বাসায় কেউ নেই নাকি? ফাকা ফাঁকা লাগছে।
বিয়ে বাড়িতে গেছে। চলে আসবে। সন্ধ্যার আগেই চলে আসবে। তুই বোস।
রানু বসল। ইসমাইল সাহেব হাত বাড়িয়ে রানুকে কাছে টানলেন। হালকা গলায় বললেন, এখনো রাগ পুষে রেখেছিস?
না মামা কারো ওপর আমার রাগ-ট্যাগ নেই।
এদিকে তো আসিস না।
ইচ্ছে করেই আসি না।
কেন?
তোমার কথা না শুনে বিয়ে করেছিলাম। খুবই রাগ করেছিলে তুমি। বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলে, মনে আছে?
ইসমাইল সাহেব কিছু বললেন না। রানু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সেই বিয়ের আজ এই অবস্থা। লজ্জাতেই আসি না।
আজি কী মনে করে এলি?
কিছু করার ছিল না। কোথাও যাবার ছিল না। তাই এসেছি।
টগরকে কার কাছে রেখে এসেছিস?
ও তার বাবার কাছে গেছে। গ্রামের বাড়িতে। ওর বাবা কিছুদিন ধরে গ্রামের বাড়িতে আছেন।
জানি।
কিভাবে জানলে?
কোন পত্রিকা যেন দেখলাম কথাসাহিত্যিকের নির্বাসন।
রানু চুপ করে গেল। ইসমাইল সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, গ্রাম নিয়ে কিছু লিখবেন বোধ হয়?
জানি না। লিখলে লিখবে। লেখালেখির ওপর আমার কোনো ভক্তি নেই। উৎসাহ-ও নেই। ঐ প্রসঙ্গ থাক মামা। অন্য কিছু নিয়ে আলাপ কর। তোমার শরীর এখন কেমন?
ভাল না। সময় বোধ হয় শেষ হয়ে আসছে।
আফসোস হয়?
না, দায়িত্ত্ব পালন করেছি। মেয়েগুলির বিয়ে দিয়েছি। ছেলেটা চাকরি করে। আফসোস থাকবে কেন? কোন আফসোস নাই।
মামা, চা খাব।
নিজে বানিয়ে খেতে হবে। কাজের ছেলেটা কোথায় যেন গেছে।
তুমি খাবে?
চা-সিগারেট আমার জন্যে নিষিদ্ধ। তবে তোর খাতিরে খাব এক কাপ।
রানু চা বানাতে গেল। সে প্রায় বার বছর এ বাড়িতে কাটিয়েছে কিন্তু তবু সব কেমন অচেনা লাগছে। পুরনো আসবাব প্রায় কিছুই নেই। ঝক ঝক করছে চারদিক। তার সময় এরকম ছিল না। এলোমেলো থাকত সব কিছু। এখন ঘর সাজায় কে? এ বাড়িতে কোনো মেয়ে নেই। মামা তার ছেলের বিয়ে দেননি। নাকি দিয়েছেন। কিন্তু তাকে জানাননি? বোধ হয় তাই। মামার সঙ্গে তার এখন আর সম্পর্ক নেই। রানু সবার কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে।
মামা তোমার চা। চিনি দেইনি। চিনি নিশ্চয় খাও না?
না, খাই না।
ইসমাইল সাহেব নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। তার স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। চায়ে চুমুক দেবার ভঙ্গি, বসে থাকার ভঙ্গি সব কিছুতেই গম্ভীর ক্লান্তির ছোঁয়া। সত্যি সত্যি কি তার সময় শেষ হয়ে এসেছে? যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রানুর বড় মায়া লাগল। ইসমাইল সাহেব বললেন, আজ রাতটা আমার এখানে থেকে যা। বুলুর বিয়ে দিয়েছি, ওর বৌকে দেখবি।
বুলুর বিয়ের কথা আমাকে তো কিছু বলনি।
বলার মত বিয়ে নয়। বলার মত হলে বলতাম।
ইসমাইল সাহেব ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে মাথা রাখলেন।
তোমার শরীর এত খারাপ তবু সবাই তোমাকে এক ফেলে চলে গেল?
ওরা যেতে চায়নি। আমি জোর করে পাঠিয়েছি। সব সময সবাই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত, এটা সহ্য হয় না।
রানু খানিক্ষণ ইতস্তত করে বলল, মামা আমি টগরকে নিয়ে যখন আলাদা হয়ে গেলাম তুমি কিন্তু একবারও জিজ্ঞেস করলে না কেন এরকম করলাম?
ইসমাইল সাহেব চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন কিছু বললেন না।
আমি আশা করেছিলাম তুমি অন্তত জানতে চাইবে। আমার সব কথা শুনবে এবং শেষ পর্যন্ত বলবে, যা করেছিস ভালই করেছিস।
ইসমাইল সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, যা করেছিস ভালই করেছিস।
তুমি কিছু না জেনেই বলেছ। মামা মন দিয়ে শোন, মনিকা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে টগরের বাবার খুব ভাব ছিল। মেয়েটি দারুণ রূপবতী এবং চমৎকার মেয়ে। মামা তুমি কী আমার কথা শুনিছ?
ইসমাইল সাহেব জবাব দিলেন না। রানু, দেখল তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
সন্ধ্যা মিলিয়েছে। গাছে গাছে পাখ-পাখালি ডাকছে। আকাশে মেঘ। আজও বোধ হয় ঝড়বৃষ্টি হবে। রানু ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল।
অপলা পৌঁছল সন্ধ্যা মিলাবার পর
অপলা পৌঁছল সন্ধ্যা মিলাবার পর।
ট্রেন থেকে নেমেই সে একটি নিঃশ্বাস গোপন করল। আকাশ মেঘে কালো হয়ে আছে, ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। অল্প কিছু লোক নেমেছে ট্রেন থেকে, তারা মুহূর্তের মধ্যে উধাও। ফাকা স্টেশন। চারদিক নিশুতি রাতের মত নীরব। অপলা ট্রগরের হাত ধরে বলল, ভয় লাগছে টগর?
না। কিসের শব্দ হচ্ছে খালা? কি জানি, ঝিঝি পোকা বোধ হয়। তোর ভয় লাগছে না তো?
না।
ভয়ের কিছু নেই। তোদের দাদার বাড়ি এখানে সবাই চিনে। বললেই হবে, মোক্তার বাড়ি। স্টেশন থেকে কোয়ার্টার মাইল।
কোয়ার্টার মাইল কী?
কোয়ার্টার মাইল হচ্ছে খুব কাছে। তোর ভয় লাগছে না তো?
না।
বৃষ্টি নামার আগে আগেই পৌঁছে যাব। আর না হয় বৃষ্টিতে অল্প ভিজব। কি বলিস মজাই হবে।
টগর উত্তর দিল না। তার মোটেই ভয় লাগছে না। বেশ মজাই লাগছে। বৃষ্টি নামলে আরো মজা হয়। শুধু ঝিঝি পোকার ডাকটা শুনতে কেমন লাগছে। এই পোকাগুলি মানুষকে কাড়য়ায় কিনা কে জানে। এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হচ্ছে, কিন্তু সে জানে জিজ্ঞেস করলে ঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না। অপলা বলবে, না না কামড়ায় না। টগর লক্ষ্য করল খালামণি কেমন অসহায় ভঙ্গিতে সুটকেস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে বোধ হয় কাউকে জিজ্ঞেস করতে চান কোনদিকে যেতে হবে। কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারছে না।