ভোর হচ্ছে।
একতলায় মোরগ, ডাকছে। রানু উঠে পড়ল। উঁকি দিল পাশের ঘরে। টগরের মাথা বালিশ থেকে সরে গেছে। কিন্তু দুহাতে সে অপলাকে জড়িয়ে ধরে আছে।
কত চমৎকার সব দৃশ্য চারদিকে। তবু কত অর্থহীন এই বেঁচে থাকা।
আকাশ মেঘলা ছিল
সারা বিকাল আকাশ মেঘলা ছিল। সন্ধ্যা বেলা চারদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি নামল। রানু অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল বৃষ্টির শব্দে। খোলা জানালায় বৃষ্টির ছাট আসছে। ঘরের ভেতর প্রচুর হাওয়া। রানু চোখ না মেলেই হাত বাড়ল, টগর নেই। তার সঙ্গেই শুয়েছিল। এক ফাকে উঠে চলে গেছে।
টগর! টগর!
কী মা?
কি করছ, তুমি?
কিছু করছি না।
টগর কথা বলছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। বৃষ্টিতে ভিজছে নিশ্চয়ই। রানু এসে দেখে সত্যি তাই। রেলিং ধরে টগর বসে আছে। গা মাথা ভিজে সাপ সাপ করছে। চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। দৃশ্যটি কেমন যেন অন্য রকম। যেন এই ছেলেটির কেউ নেই। বারান্দায় বসে বসে কাঁদছে।
বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক না টগর। ভেতরে আস।
আসছি।
টগর এল না। ঠিক আগের মতই বসে রইল। রানুর ইচ্ছা হল কড়া গলায় একটা ধমক দিতে। সে ধমক দিল না। নিজেকে চট করে সামলাল। ছোট বাচ্চাদের খানিকটা নিজের মত থাকতে দিতে হয়। কিছুক্ষণ ভিজলে এমন কি আর ক্ষতি হবে?
টগর!
কি মা?
অপলা কোথায়? আসেনি এখনো?
না।
তুমি কি আপলার জন্যেই রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছ?
টগর জবাব দিল না। সম্ভবত সে অপলার জন্যেই অপেক্ষা করছে। অপলা খাতাপত্র কি সব কেনবার জন্যে নিউমার্কেটে গিয়েছে। এতক্ষণে চলে আসার কথা। আসছে না কেন, কে জানে।
রানুর মনে হল অপলার অনেক সাহস হয়েছে। আগে একা একা কোথাও যেত না। এখন যাচ্ছে। গত সপ্তাহে কলেজ থেকে ফিরল সন্ধ্যা পার করে। তাদের কি নাকি ফাংশান ছিল। রানু দেখল ফর্সা মত রোগা একটি ছেলে এসেছে তার সঙ্গে। অনেক দিনের পরিচিত এমন ভঙ্গিতে ছেলেটি কথা বলছিল। অপলা বলল, চা খেয়ে যাও সিরাজ। ছেলেটি তার উত্তর দেয়নি। মাথা বাকিয়েছে। যার মানে হ্যাঁ কিংবা না দুই হতে পারে।
রানু একবার ভেবেছিল বলবে, রিকশায় একজন ছেলের সঙ্গে আসা ঠিক না। এ রকম আর কোনো দিন আসিস না। রিকশায় দু’জন পাশাপাশি বসা মানেই গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে বসা। এভাবে বসলেই শরীর কথা বলতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এসব কথা বলা হয়নি। কারণ কথাগুলি তার নিজের নয়। ওসমানের কথা। অন্যের কথা নিজের ভেবে বলার কোনো অর্থ হয় না।
রানু বাতি জ্বালাতে গিয়ে দেখল ইলেকট্রসিটি নেই। শহরের ইলেকট্রসির এমন অবস্থা। একটু ঝড়বৃষ্টি হলেই কারেন্ট নেই। আর একবার নেই হলে সারা রাতের জন্যে নেই। রানু হারিকেন জ্বালাল। হারিকেনে তেল নেই। কতক্ষণ জুলিবে কে জানে। ড্রয়ারে মোমবাতি ছিল। কিন্তু এখন নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সে চায়ের পানি চাপিয়ে আবার বারান্দায় এল। টগরের ঠাণ্ডা লাগছে। কিছুক্ষণ পর পরই কেঁপে উঠছে। নীল হয়ে আছে ঠোঁট। কতক্ষণ ধরে সে বৃষ্টিতে ভিজছে?
টগর!
কী মা?
এসো মাথা মুছিয়ে দেই।
টগর উলে এল। কোনো আপত্তি করল না।
চা খাবে বাবা? তোমাকে একটু আদা চা করে দেই?
টগর অবাক হয়ে বলল, আমি বড় হয়ে গেছি, না?
হ্যাঁ তুমি বড় হয়েছ। অনেক বড়।
এখন আমি রোজ চা খাব?
হ্যাঁ খাবে।
রানু মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে হালকা গলায় বলল, শুধু চা না, চাইলে সিগারেটও এনে দেব।
দূর।
রানু হেসে ফেলল। টগর উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। শীতে সে অল্প অল্প কাঁপছে। রানুর বড় মায়া লাগল। নির্বিরোধ শান্ত ছেলে হয়েছে টগর। কারো প্রতি তার কোনো অভিযোগ নেই।
রানু পিরিচে চা ঢেলে দিল। টগর কেমন বিড়ালের বাচ্চার মত চুক চুক করে চা খাচ্ছে। একবার মুখ তুলে মাকে দেখল এবং হেসে ফেলল।
আমাদের টগর সোনামণি আজ এত খুশি কেন?
এমনি।
না। এমনি নয়। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।
টগর লজ্জিত ভঙ্গিতে পকেটে হাত দিয়ে এক টুকরো কাগজ বের করল। নীল রঙের চিঠির কাগজ। সে কাগজটা মার দিকে বাড়াল না। টেবিলে রেখে মাথা নিচু করে হাসতে লাগল।
কি এটা? চিঠি?
হুঁ।
কার চিঠি? কে লিখেছে?
আব্বা।
রানু কাগজ তুলে নিল। ওসমানের চিঠি নয়। চিঠিটা অপলার লেখা। বাবার চিঠি এসেছে এই বলে সে নিশ্চয়ই টগরকে বুঝিয়েছে। মেয়েলি ধরনের একটা ট্রিক। রানু অপ্রসন্ন মুখে চিঠিতে চোখ বোলাতে লাগল।
প্রিয় টগর সোনা,
তুমি কেমন আছগো? তোমার কথা খুব ভাবি। লেখালেখি নিয়ে খুব ব্যস্ত তাই আসতে দেরি হচ্ছে। তুমি এক কাজ কর না কেন–চলে এসো এখানে। তুমি এলে খুব মজা হবে। আমরা খুব বেড়াব।
পুকুরে সাঁতার কাটিব। আসবে না তুমি? না এলে আমি রাগ করব। আসবে, আসবে, আসবে।
রানু ভ্রূ কুঁচকে দীর্ঘ সময় চিঠিটির দিকে তাকিয়ে রইল। এই নকল চিঠিটা কি উদ্দেশ্যমূলক নয়? অপলা কি এখানে সূক্ষ্ম একটা চাল দেয়ার চেষ্টা করছে না? সে নিশ্চয়ই ভেবেছে টগর চিঠি পেয়েই ব্যস্ত হয়ে উঠবে বাবার কাছে যাবার জন্যে। টগর অবশ্যি সে রকম কিছু করছে না। রানু একবার ভাবল বলে, টগার, এটা একটা নকল চিঠি। এ চিঠি তোমার বাবার লেখা নয়। কিন্তু সে তা বলল না।
বাইরে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। অপলার দেখা নেই। কত দেরি করবে। সে? রানুর মনে হল অপলাকে কিছু বলা দরকার। স্বাধীনতা মানে রাত করে বাড়ি ফেরা নয়। সে নিজে একজন স্বাধীন মহিলা কিন্তু সে কি রাত-বিরেতে বাড়ি ফিরে না।