অপলা, টগর কী জেগে আছে?
হুঁ আছে।
টগর! টগর।
কী?
আমার সঙ্গে ঘুমাবে না?
ঘুমাব।
তাহলে এসো।
আসছি।
কিন্তু টগর উঠে এল না। যেন মাকে সান্তুনা দেবার জন্যেই বলা। বানু ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলল, অপলা, তুই চিঠিতে কী লিখেছিস?
তেমন কিছু না। আপা। আসতে লিখেছি। এর বেশি কিছু না।
খুব ইনিয়ে-বিনিয়ে লেখা তাই না?
হ্যাঁ।
আচ্ছা ঘুমো।
টগরকে নেবে না?
না। ও তোর সঙ্গেই থাক।
রানুর একফোটাও ঘুম এল না। হাতের কাছে টগর নেই। বিছানাটা সেই কারণেই কী বিশাল লাগছে? এক সময় তার মনে হল একটা বিশাল মাঠের মাঝখানে সে শুয়ে আছে। তার ভয় ভয় করতে লাগল। ওসমান সব সময় বলত, জীবজগতে মানুষ হচ্ছে একমাত্র প্রাণী, যে একা একা থাকতে পারে। অন্য কোনো প্ৰাণী পারে না। তাদের সঙ্গি বা সঙ্গিনী প্রয়োজনে, তবে মানুষ অসাধারণ কল্পনা শক্তির অধিকারী বলেই সে নিঃসঙ্গ সময়টায় সঙ্গি কল্পনা করে নেয় এবং এক সময় একা থাকাটা তার অভ্যাস হয়ে যায়।
টগরের বাবার নিশ্চয়ই একা থাকাটা এতদিনের অভ্যাস হয়ে গেছে? রানু এপাশি-ওপাশ করতে লাগল। পাশের ঘরে বাতি জ্বলছে। অপলা বাথরুম করাচ্ছে বাবুকে। খুব সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছে দুজনে।কী এত কথা ওদের? গুজণ্ডজ ফুসফুস। কান পাতলে হয়ত শোনা যাবে, কিন্তু কান পাততে ইচ্ছে করছে না। টগর হাসছে। তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে হাসছে অপলা। ওদের দুজনের একটি গোপন জগৎ আছে। রানুর সে জগতে প্রবেশের অধিকার নেই। জোর করে সে অধিকার আদায় করা কী সম্ভব? রানু কী এখন ডাকতে পারে টগরকে? শান্ত শীতল গলায় বলতে পারে,
তোরা কী নিয়ে হাসছিস টগর? আমাকেও দলে নিয়ে নে। আমারও হাসতে ইচ্ছে করছে। আমিও হাসব।
কিন্তু কেউ তাকে দলে নিবে না। আমি ছিলাম। সারাজীবন দল ছুটি। ক্লাস নাইনে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে চারজন করে গ্রুপিং হবে। একচল্লিশজন ছাত্রী ক্লাসে। দশটি গ্রুপ। সে বাদ পড়ল। তাকে নিয়ে ছাত্রীরা কেউ গ্রুপ করেনি। বদিউজ্জামান স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন, কোন এক গ্রুপের সঙ্গে চুকে যা। হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কিন্তু ঢুকবে কার সঙ্গে? যাদের কাছেই গেছে তারাই বলেছে, তুমি ভাই অন্য গ্রুপে যাও। সে সময় তার বয়স কম ছিল। আবেগ ছিল প্রচুর। সেও শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের মতই কাঁদতে শুরু করল। চোেখ মুছতে মুছতে বদিউজ্জামান স্যারকে বলল, স্যার আমি সায়েন্স পড়ব না। স্যার অবাক হয়ে বললেন, কেউ তোকে গ্রুপে নিচ্ছে না। এই জন্যে সায়েন্স পড়া ছেড়ে দিবি? রানু ফোপাতে ফোপাতে বলল, সে জন্যে না স্যার। সায়েন্স পড়তে আমার ভাল লাগে না।
সায়েন্স কী পড়েছিস যে বুঝে ফেললি সায়েন্স পড়তে ভাল লাগে না? আর ফিচ, ফিচ করে কাঁদছিস কেন?
মাথাব্যথা করছে স্যার। এ জন্যে কাঁদছি।
আবার মিথ্যা কথা? মাথা মুড়িয়ে দেব, বুঝলি?
বদিউজ্জামান স্যার কথায় কথায় বলতেন মাথা মুড়িয়ে দেব। কেউ অঙ্ক পারল না। স্যার হুংকার দিয়ে বললেন, কাল একটা ক্ষুর নিয়ে আসবি তোর মাথা মুড়িয়ে দেব। কেউ ক্লাসে লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়েছে–স্যারের চোখে পড়ল, স্যার বললেন, দপ্তরী কালিপদকে ডেকে নিয়ে আয়, ওকে দিয়ে একটা সেভেন ও ক্লক ব্লেড আনিয়ে তোর মাথা মুড়িয়ে দেব।
একজন মানুষ সমগ্র জীবন অল্প কয়েকজন ভাল মানুষের সাক্ষাৎ পায় যারা তার ওপর অসাধারণ প্রভাব ফেলে। বদিউজ্জামান স্যার সে রকম একজন মানুষ। ক্লাস নাইনের সেই প্রাকটিক্যাল ক্লাসে রানু লজ্জা ও অপমানে মরে যেতে বসেছিল। ইচ্ছা করছিল ছুটে গিয়ে কোনো একটা চলন্ত গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। হয়ত করেও বসত সেরকম কিছু। বদিউজ্জামান স্যার তাকে দুঘণ্টা তার সামনের চেয়ারে বসিয়ে রাখলেন। যতবারই সে বলছে, স্যার উঠি? ততবারই স্যার বলেছেন, আহা বোস না। এত তাড়া কিসের? সে বসেছিল মাথা নিচু করে। শুধু সামনে বসে থাকা… কোনো কথাবার্তা নেই। এক সময় তিনি বললেন, আচ্ছ যা এখন বাড়ি যা। একা তোর জন্যে একটা গ্রুপ করে দেব। ভালই হবে। কাজকর্ম ভাল শিখবি। আরেকটা কথা শোন ছোটখাটো দুঃখ-কষ্টকে আমল দিতে নাই। ক্লাসে মেয়েরা তোকে পছন্দ করছে না। তাতে কিছু যায় আসে না। আমি তো করছি। আমার তো মনে হয় তোর মত ভাল মেয়ে আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে কম দেখেছি। ছত্ৰিশ বছর ধরে মাস্টারি করছি, কম দিন তো নয়। কি বলিস? তুই ভাল মেয়ে। খুব ভাল। এটা কখনো ভুলবি না।
এটা স্যারের একটা মিথ্যা কথা। ক্লাসের সব মেয়েকেই স্যার এই কথা কোনো না কোনো সময় বলেছেন। কিন্তু কত মধুর সেই মিথ্যাটি পৃথিবীতে মধুর মিথ্যার সংখ্যা এত কম কেন ভাবতে ভাবতে রানু চোখ মুছল।
বিয়ের পর সে গিয়েছিল স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি চিনতে পারলেন না। অবাক হয়ে বললেন, তুমি কোন ব্যাচের মা? কি যেন নাম তোমার? রানু মৃদু স্বরে বলেছিল, আপনি আমাকে একবার আশা ও আনন্দের কথা শুনিয়েছিলেন। সেই কথাগুলি আমি প্রায়ই ভাবি। আমার হ্যাসব্যান্ডকে আপনার কথা বলেছিলাম। তিনি আপনাকে দাওয়াত করেছেন। আপনি কী একবার আসবেন আমাদের বাসায়?
কি করেন তোমার স্বামী?
তিনি একজন লেখক। আপনি হয়ত চিনবেন।
স্যার চিনলেন এবং উচ্ছসিত হলেন।
মা তোমার পরম সৌভাগ্য তুমি এমন একজনের পাশে আজ যিনি একজন অত্যন্ত উঁচুদরের মানুষ। যিনি শোকে ও দুঃখে মানুষকে পথ দেখান, আশা ও আনন্দের কথা বলেন। এরা মানব জাতির বিবেক। এদের পাশে থাকা ভাগ্যের কথা। কিন্তু মা তার সঙ্গে দেখা করতে আমি যাব না। তার সঙ্গে দেখা করার যোগ্যতা আমার নাই। আমি সামান্য মানুষ।