ওসমান সাহেব বসলেন। ঘরে কফি নেই। কফির কথা বলা হল না। নবী ঠিক কী বলতে এসেছে বুঝতে পারছেন না। অনুমান করতেও চেষ্টা করলেন না। নবীর ব্যাপারে আগেভাগে কিছু অনুমান করা মুশকিল।
নবী সিগারেট ধরাল। গম্ভীর হয়ে বলল, একটা সায়েন্স ফিকশন লেখার কথা ভাবছি। আইডিয়াটা নিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছি।
সায়েন্স ফিকশনের আইডিয়া নিয়ে আলাপ করবার জন্যে কেউ দুপুর রাতে অন্যের বাড়ি যায় না। ওসমান সাহেবের মনে হল এটা হচ্ছে প্রস্তাবনা। এরপরে আসল কথা আসবে।
আইডিয়াটা এ রকম-একটি গ্রহের কথা আমি বলবি। সেই গ্রহে প্ৰাণের বিকাশ হয়েছে অদ্ভুতভাবে। সেখানে পুরুষ এবং নারী বলে কিছুই নেই। যৌনতার ব্যাপারটি নেই। সবাই জীবনের এক পর্যায়ে গৰ্ভধারণ করে। ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র এদের মৃত্যু হয়। কাজেই সে গ্রহে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কোনো ব্যাপার নেই।
গৰ্ভধারণের ব্যাপারটিই হয় কিভাবে?
সেটা নিয়ে এখনও ভাবিনি। তবে যৌন মিলনের কোনো ব্যাপার নেই। আইডিয়া হিসেবে আপনার কাছে কেমন লাগছে?
ভালই।
শুধু ভালই বলাটা ঠিক হল না। এই গল্পে নতুন ধরনের জীবনযাত্রা, নতুন ধরনের সমাজ ব্যবস্থা আমি আনব। এ ধরনের একটি আইডিয়াকে শুধু ভালই বলে চালানো ঠিক নয়। আপনি বলুন–খুব চমৎকার আইডিয়া।
খুব চমৎকার আইডিয়া।
নবী উঠে দাঁড়াল, আপনার বাথরুমটা ব্যবহার করতে চাই।
আসুন দেখিয়ে দিচ্ছি।
হুইস্কি আমার সহ্য হয় না। বমি করতে হবে। দামী একটা নেশা বমি করে নষ্ট করাটা ক্রাইম। কিন্তু উপায় নেই।
নবী বাথরুম থেকে বের হতে অনেক দেরি করল। ওসমান সাহেব আকবরের মাকে দিয়ে লেবু চা বানালেন। নেশা, উগরে দেওয়ার পর চা খেতে হয় তো ভাল লাগবে। নবী চা খেল না। কোট কাঁধে ফেলে বলল, আমি এখন যাব।
চা খাবেন না?
না, আগেই তো বলেছি খাব না।
ওসমান সাহেব নবীকে এগিয়ে দেবার জন্যে রাস্তা পর্যন্ত এলেন। নবীর লাল রঙের ওপেল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। যে ঠিকমত পা ফেলতে পারছে না। সে গাড়ি চালিয়ে যাবে ভাবতেই অস্বস্তি বোধ হয়।
নবী ড্রাইভিং সিটে বসে সে হঠাৎ বলল, মনিকার সঙ্গে কী আজ সারাদিনে আপনার কোনো যোগাযোগ হয়েছে?
না। টেলিফোনেও কোন কথা হয়নি?
না। কেন?
নবী গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। নিচু গলায় বলল, মনিকার স্বামী মারা গেছে। আমার ধারণা ছিল সে আপনাকে জানিয়েছে।
কবে মারা গেছে?
কবে মারা গেছে জানি না। মনিকা খবর পেয়েছে আজ ভোরে। আমি দেখতে গিয়েছিলাম। খুব কান্নাকাটি করছিল।
ওসমান সাহেব কিছু বললেন না। মনিকা খুব কান্নাকাটি করছে এই দৃশ্যটি তিনি কল্পনা করতে চেষ্টা করলেন। সে চেঁচিয়ে নিশ্চয়ই কাব্দবে না, কিংবা কে জানে হয়ত চেঁচিয়েই কাদবে। একটি অত্যন্ত রূপসী মেয়ে কাঁদছে। দৃশ্যটি কল্পনায় চমৎকার কিন্তু বাস্তবে কুৎসিত। বেশ কিছু সুন্দরী মেয়েকে তিনি কাঁদতে দেখেছেন। তার কাছে কখনও ভাল লাগেনি।
নবী বলল, আমি ঠিক স্টেডি ফিল করছি না। গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আজ রাতটা আপনার ঘরে কাটিয়ে দেয়া যাবে?
যাবে। আসুন।
নবী গাড়ি লক করে দোতলায্য উঠে এল খুব সহজভাবেই বলল, কাউকে বলুন গরম পানি করে দিতে, আমি একটা হট সাওয়ার নেব। একটা স্যান্ডউইচ বা এই জাতীয় কিছু দিতে বলুন। ভাল কথা, আমার শোবার ঘরে কিছু কাগজ রাখবেন। মাঝেমধ্যে শেষ রাতের দিকে আমার লিখতে ইচ্ছা করে।
ওসমান সাহেব মৃদু হাসলেন। উপহাসের হাসি কিনা ঠিক ধরা গেল না।
ওসমান সাহেব।
বলুন।
আসুন। একটা কাজ কবা যাক ২ সায়েন্স ফিকশনের যে আইডিয়ােটা আপনাকে বললাম তার ওপর আপনি একটি লেখা তৈরি করুন। আমিও একটি করি।
কেন?
কে আইডিয়া কেমন খেলাতে পারে। তাই দেখা, এর বেশি কিছু নয়। আপনি যা ভাবছেন তা না।
আমি কী ভাবছি?
আপনি ভাবছেন এটা একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপার। তা নয়। এ দেশে আমি কাউকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না।
ওসমান সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, আপনার বিছানা তৈরি আছে, আসুন ঘর দেখিয়ে দিই। নবী রুক্ষ স্বরে বলল আপনি কী আমার ওপর বিরক্ত?
না, আমি সহজে বিরক্ত হই না।
তাহলে আমার আইডিয়া নিয়ে আপনি লিখতে চান না?
না।
ওসমান সাহেব ঘুমুতে গেলেন অনেক রাতে। নবী প্রচুর ঝামেলা করল। গরম পানি দিয়ে গোসল করল। চা খেল। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে হো হো করে হাসল নিজউ কিভাবে দেয় দেখেছেন? চাচার হাতে ভাতিজা খুন। চাচার হাতে খুন লিখলেই তো বুঝা যায় ভাতিজা খুন। হয়েছে। কী দরকার ভাতিজা খুন লেখা।
খবরের কাগজ পড়া শেষ হবার পর সে টেলিফোন নিয়ে বসল। রাত তখন দেড়টা। এই গভীর রাতে কাকে যেন ঘুম থেকে তুলে ধমকাতে শুরু করল। পরীক্ষণেই অন্য কাউকে টেলিফোন করে মজার মজার সব কথা বলে খুব হাসতে লাগল।
ওসমান সাহেব জেগে রইলেন অনেক রাত পর্যন্ত। ঘুমের অনিয়ম হয়েছে। সারারাত হয়ত জেগে থাকতে হবে। একা একা জেগে থাকা একটা যন্ত্রণার ব্যাপার। পাশের কামরায় নবী অবশ্যি এখনও জেগে। কী সব খুটিখাট করছে তবু একা একাই লাগছে নিজেকে।
তিনি মশারির ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট নিলেন। মশারির ভেতর সিগারেট খাওয়া রানু খুব অপছন্দ করত। কিন্তু এর মধ্যে একটি মজার ব্যাপার আছে ধোঁয়া আটকে থাকে মশারির ভেতর। যেন সাদা মেঘ চারপাশে জমতে শুরু করেছে। বিশাল মেঘের টুকরো নয় ছোট্ট একটি নিজস্ব মেঘ। এবং এটিকে তৈরি করেছেন নিজেই।