জি বলব।
ঠিক আছে তোমার বলার দরকার নেই। তাকে বলবে। আমার সঙ্গে দেখা করতে।
জি আচ্ছা।
তাছাড়া ও তো রেগুলার ক্লাসেও আসে না। বাড়িতে শাসন না থাকলে যা হয়।
নীলু। এসব শুনে গা দুলিয়ে হাসতে লাগল, দূর ঐ ছেলের সঙ্গে আমি ঘষাঘষি করব কেন? আমাকে জিজ্ঞেস করল কটা বাজে। আমি বললাম। তারপর আমি বললাম।–আপনার হাতে তো ঘড়ি আছে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? সে ব্যাটা একদম ঘাবড়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল আমার ঘড়ি নষ্ট। আমি বললাম— মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে খুব ভাল লাগে, না? ছেলেটার যে কী অবস্থা। দূর থেকে অন্য বন্ধুগুলি তাকে দেখছে। হি-হি-হি। ঐ পাঁজিগুলি আগে আমাকে দেখলেই শিস দিত। এখন আর দেয় না।
আর কথা হয়নি। ঐ ছেলের সাথে?
আর কথা হবে কেন?
সেলিনা আপা বাবার সঙ্গে কথা বলবেন।
বলুক।
বাবা খুব রাগ করবেন।
করলে করবে।
বাবা সত্যি সত্যি রাগ করলেন। বেশ রাগ। চিৎকার চেঁচামেচি। শুধু তাই না, এক পর্যায়ে প্রচণ্ড একটা চড় কষিয়ে দিলেন। নজমুল চাচা ছুটে এলেন, ছিঃ ছিঃ এসব কী কাণ্ড! মেয়ে বড় হয়েছে না?
বাবা ঝাঁঝাল স্বরে বললেন, ওর স্কুল এখন বন্ধ। তুমি একটা ছেলে দেখ তো, ওর বিয়ে দিয়ে দেব।
আচ্ছা সেটা দেখা যাবে। বিয়ে দিতে চাইলে বিয়ে দেবে। বিলু, মা, তুমি আমাদের দুকাপ চা দাও তো। লেবু দিয়ে।
নীলু যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে বলল, আমাকেও এক কাপ চা দিস তো।
পরদিন নীলু স্কুলে গেল না। সন্ধ্যাবেলা বাবার সামনেই তার সমস্ত বই-খাতা বারান্দায় জমা করতে লাগল। বাবা ইজিচেয়ারে বসে অবাক হয়ে দেখতে লাগল।
কী করছিস নীলু?
বইপত্রগুলি সব ফেলে দিচ্ছি বাবা। পড়াশোনা তো আর করছি না। বই দিয়ে কী হবে?
পড়াশোনা করবি না আর?
না। তুমি নিষেধ করলে। তাছাড়া আমারও ভাল লাগে না।
কী করবি ঠিক করেছিস?
এখনো কিছু ঠিক করিনি।
বাবা আর কিছু বললেন না। রাতে ভাত খাবার সময় হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, রাগে মাথায় অনেকে অনেক কিছু বলে, সে সব মনের মধ্যে পুষে রাখা ঠিক না।
নীলু মুখ না তুলেই বলল, আমি মনের মধ্যে কিছু পুষে রাখিনি।
আর কোনো কথাবার্তা হল না।
সে রাতে বাবা বাইরে গেলেন না। গম্ভীর হয়ে সেতারার পড়া দেখিয়ে দিতে বসলেন। সেতারা ক্লাস সিক্সে উঠেছে। নতুন ক্লাসে উঠেছে বলেই পড়াশোনায় খুব আগ্রহ। সে হাসিমুখে তার বইপত্র দেখাতে লাগল। বাবা এক সময় আমার পড়াশোনারও খোঁজ নিলেন, পড়াশোনা ঠিকমত হচ্ছে তো?
জি হচ্ছে।
প্রি-টেস্ট কবে?
এখনো দেরি আছে।
কোন কলেজে পড়বি কিছু ভোবিছিস? ঢাকায় যেতে চাস নাকি?
নাহ।
ঢাকা না যাওয়াই ভাল, যা গোলমাল। এই স্ট্রাইক ওই স্ট্রাইক।
তা ঠিক।
নীলু আমাদের কাছেই কি-একটা গল্পের বই নিয়ে উবু হয়ে আছে, যেন কোনো কিছুই তার কানে যাচ্ছে না।
নীলু এত মন দিয়ে কী পড়ছিস?
ভূতের গল্প।
নাম কী?
ডাকবাংলা রহস্য।
খুব ভয়ের নাকি?
খুব না। কিছু ভয়ের।
বাবা হঠাৎ বললেন, তোরা সবাই মিলে মামার বাড়ি থেকে ঘুরে আয় না। একটা চেঞ্জ হবে। সেতারার তো বোধহয় মনেই নেই।
মনে আছে বাবা, পুকুর পাড়ে দুটো তাল গাছ আছে। আর পুকুরের ঘাটে বসে থাকলে এক রকম মাছ আসে। চোখগুলো বড় বড়। ঠিক না নীলু আপা?
হুঁ। চ্যালা মাছ।
বাবা আবার বললেন, কী রে যাবি তোরা? যাস যদি তোর মামাকে লিখি। এসে নিয়ে যাবে।
তুমি যাবে না?
নাহ। আমার ব্যবসাট্যবসা খুব খারাপ। তোরা তো জানিস না। অবশ্যি আমি নিজেই বলি না। কিছু। প্রেসটা আমি খুব সম্ভব বিক্রি করে দেব। বয়স হয়ে গেছে, এইসব ঝামেলা এখন আর ভাল লাগে না।
নীলু বাবার কথা শুনল, কিন্তু কিছু বলল না।
যাবি মামার বাড়ি?
যাওয়া যায়।
আচ্ছা ঠিক আছে, লিখে দেব তোর মামাকে। পৌষ মাসের দিকে গেলে ধান কাটা দেখবি।
সে রাতে ঘুমাতে গেলাম দশটার দিকে। সেতারা তার বালিশ নিয়ে এসে হাজির। আপা, আজ তোমার সঙ্গে ঘুমাব।
আয়। হঠাৎ আমার সঙ্গে যে।
নীলু আপা বলেছে আজ সে একা একা ঘুমোতে চায়।
বাতি নেভাতে সেতারা ফিসফিস করে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করি আপা, রাগ করবে না তো?
না রাগ করব কেন?
আগে গা ছুঁয়ে বল রাগ করবে না।
রাগ করব না, বল।
সেতারা বেশ খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, মেয়েদের যখন শরীর খারাপ থাকে তখন কোনো ছেলেকে চুমু খেলে নাকি পেটে বাচ্চা হয়?
বলেছে কে এসব?
বলছে কে এসব?
না হয় না। এই সব জিনিস নিয়ে না ভাবাই ভাল।
তাহলে বাচ্চা কিভাবে হয়?
জানি না কিভাবে হয়, ঘুমা তো।
সেতারা ঘুমিয়ে পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। সেতারাও অনেকটা আমার মত, এ বাড়িতে তার কথা বলার কেউ নেই। স্কুলে তেমন বন্ধুবান্ধব নেই। সেদিন দেখলাম টিফিনের সময় ওদের ক্লাসের সব মেয়ে মিলে চুলটান। বিবিয়ানা সাহেববাবুর বৈঠকখানা খেলা খেলছে। সেতারা দূরে দাঁড়িয়ে তৃষিত নয়নে দেখছে।
আমি সেতারার গায়ে হাত রাখতেই সেতারা বলল, মাকে কাল রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি আপা। খুব লম্বা লম্বা চুল।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তুই ঘুমাসনি?
উঁহু।
আয় দুজনে মিলে এক কাজ করি, নীলুকে ভয় দেখিয়ে আসি।
সেতারা উত্তেজনায় উঠে বসল। কিভাবে ভয় দেখাবে? জানালার কাছে গিয়ে ‘হুঁম’ করবে?
তা করা যায়। যাবি?
চল।
আমরা দরজা খুলে পা টিপে টিপে বাইরে এসে দেখি বাবা ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। তার পাশের মোড়ায় গুটিশুটি মেরে নীলু বসে আছে। বাবা নীলুর মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। নীলু। সম্ভবত কাদছে। বাবা আমাদের দেখে হালকা গলায় বললেন, কিরে সেতারা–বাথরুমে যাবি নাকি?