সেতারা পড়েছে খুব মুশকিলে। সে রাতে কার সঙ্গে ঘুমোবে বুঝতে পাছে না। আমাকে সে ঠিক পছন্দ করে না। বাবার সঙ্গেও থাকতে চায় না। কিন্তু নীলু বলে দিয়েছে সে একা একা ঘুমোবে। আমি সেতারাকে বললাম, ওর যা ভূতের ভয়, দেখবি রাত আটটা বাজিলেই এই ঘরে চলে আসবে কিংবা তোকে নিয়ে যাবে।
সেতারা খুব-একটা ভরসা পাচ্ছে না। সে মুখ কালো করে দুপুর থেকেই আমার পেছনে ঘুরছে।
ছুটির দিন বিকালে সাধারণত নজমুল চাচা আমাদের সঙ্গে এসে চা খান। আজ তিনি খবর পাঠালেন তার ঘরে গিয়ে যেন আজকের চাটা খাওয়া হয়। তিনি মুক্তাগাছার মণ্ডা আনিয়েছেন। নীলু বলল, দূর–আমি যাব না।
যাবি না কেন?
আমার মাথা ধরেছে।
দুটো এসপিরিন খা।
বললাম তো ভাল লাগছে না।
নীলু তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
নজমুল চাচার শরীর ভাল ছিল না। চাদর মুড়ি দিয়ে বসে ছিলেন। নজমুল চাচা, সাধারণত চা খেতে খেতে মজার মজার গল্পগুজব করেন। আজ সে সব কিছুই হল না। নজমুল চাচা বিরসমুখে বললেন, তোর বাবার একটা বিয়ের কথা হচ্ছে। মেয়েটির হাসবেন্ড মারা গেছে একাত্তুরের যুদ্ধে। একটি ছেলে আছে। ন’বছর বয়স। ছেলেটা তার নানার কাছে থাকে।
আমি কিছু বললাম না। নজমুল চাচা বললেন, মেয়েটা খুব ভাল। আমি চিনি। প্রাইমারি স্কুলের টিচার। একদিন নিয়ে আসব। এখানে। তোরা কথাবার্তা বলিস।
জি আচ্ছা।
সৎ মায়ের অত্যাচার-টত্যাচার সম্পর্কে যা শোনা যায় সে সব ঠিক না। তাছাড়া তোরা তো যথেষ্ট বড় হয়েছিস। এত বড় বড় মেয়েরা তো সাধারণত বন্ধুর মতো হয়। ঠিক না?
জানি না, হয়ত হয়।
তোর বাবার অবস্থাটা দেখতে হবে না? রাত-বিরাতে বাড়ি ফেরার বাজে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।
আমি চুপচাপ বসে রইলাম।
নীলু আসেনি যে?
ওরা নাকি মাথা ধরেছে।
ও নাকি পরীক্ষা খুব খারাপ করেছে?
জি।
সংসারে বিশৃঙ্খলা আসার জন্যে এটা হয়েছে। বুঝতে পারছিস তো?
চাচা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, রমজান ভাই এসে বলল, ইউনিভার্সিটির একজন মাস্টার নাকি নিচে বসে আছে।
চাচা অবাক হয়ে বললেন, কিসের মাস্টাের? মাস্টার এখানে কী জন্যে? বিলু তুই উপরে আমার কাছে পাঠিয়ে দে তো।
বসার ঘরে গম্ভীর চেহারার একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। বয়স খুব বেশি নয়। কিন্তু অন্য রকমের একটি ভারিক্কি ভাব আছে। ভদ্রলোক আমাকে দেখেই বললেন, একটু দেরি করে ফেললাম, না?
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আমি আগেই আসতাম। ভাবলাম জন্যদিনে খালি হাতে আসা ঠিক না। কিন্তু তোমাদের এখানে তো কিছু পাওয়া যায় না। আমি ঘণ্টাখানিক ঘোরাঘুরি করেছি। কবিতার বই পাওয়া যায়। কবিতা তো তুমি পড় না, নাকি পড়?
আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি বোধহয় নীলুর কাছে এসেছেন। আমি ওর ছোট বোন বিলু। আমরা যমজ বোন। ভদ্রলোক দীর্ঘ সময় স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন।
নীলু আমাকে বলেনি। তার যমজ বোন আছে। লোকজন কী সব চলে গেছে নাকি?
কিসের লোকজন?
আজি নীলুর জন্মদিন না?
না তো।
ও আমাকে বলেছিল আসতে। সম্ভবত ঠাট্টা। আমি বুঝতে পারিনি। আমি ঠাট্টা বুঝতে পারি না।
ভদ্রলোক চোখ থেকে চশমা খুলে কাঁচ মুছতে লাগলেন। আমি বললাম, আপনি বসুন, আমি নীলুকে ডেকে নিয়ে আসি।
তোমাদের চেহারায় অদ্ভুত মিল। যমজ বোনদের মধ্যেও কিছু ডিফারেন্স থাকে। একজন মোটা হয়। অন্যজন রোগা কিন্তু…।
ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন।
আপনি বসুন আমি এক্ষুণি ডেকে আনছি।
নীলুকে ভদ্রলোকের কথা বলতে সে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
এইসব কী রে নীলু? ভদ্রলোক কে?
মুন্নিকে তো চিনিস? মুন্নির দূর-সম্পর্কের ভাই।
তাকে আসতে বলেছিলি?
হুঁ।
কেন?
এমনি বলেছি।
আয় তাহলে। কী যে কাণ্ড।
আমি যেতে পারব না। আমার মাথা ধরেছে।
নীলুর মাথা ধরেছে এবং গায়ে বেশ জ্বর শুনে ভদ্রলোক অল্প হাসলেন।
আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তাহলে যাই। ওর জন্যে দুটো বই এনেছিলাম— দিয়ে দিও।
আপনি বসুন, চা খেয়ে যান।
তোমার বাবা আছেন?
জি না। উনি রাত করে ফেরেন।
তোমার বাবা যখন থাকবেন তখন একদিন আসব।
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। হাসিমুখে বললেন, আমি আসব। এটা বোধহয় নীলু ভাবেনি। এসে পড়েছি দেখে হকচাকিয়ে গেছে।
আপনি বসুন না, চা খেয়ে যান। উপরে নজমুল হুদা চাচা আছেন, তাঁর কাছেও বসতে পারেন।
না না, ঠিক আছে।
আমি ভদ্রলোককে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। ভদ্রলোক শান্ত স্বরে বললেন, বেশ একটা অস্বস্তিকর অবস্থা হয়ে গেল। তাই না? আমার প্রবলেম হচ্ছে আমি ঠাট্টা-তামাশা ঠিক ধরতে পারি না। মনে হয় আমার বুদ্ধিশুদ্ধি নিচু স্তরের।
বলেই ভদ্রলোক উঁচু গলায় হেসে উঠলেন। একজন ভারিক্কি ধরনের গম্ভীর চেহারার ভদ্রলোক এমন ছেলেমানুষের মতো হেসে উঠবেন আমি কল্পনাও করিনি।
নীলু বলল সে রাতে খাবে না
নীলু বলল সে রাতে খাবে না।
কোন খাবি না রে?
বললাম না। জ্বর।
রমজান ভাই কাউকে না খাইয়ে ছাড়ে না। সে ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল, রাইতে ভাত না খাইলে এক চড়ুইয়ের রক্ত পানি হয়।
নীলু শব্দ করল না। তার ঘরের দরজাও খুলল না। সেতারার মনে ক্ষীণ আশা ছিল হয়তো শেষপর্যন্ত নীলু। তাকে ডেকে নেবে। সে সব কিছুই হল না। রাত নটা বাজতেই নীলু। তার ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল।
খুব বৃষ্টি হল সে রাতে–ঝমঝম করে বৃষ্টি। আকবরের মা বলল, আশ্বিন মাসে বিষ্টি, লক্ষণ খুব বালা।
আমি অনেক রাত পর্যন্ত বাবার জন্যে অপেক্ষ করতে লাগলাম। বাবাকে কী সব খুলে বলা উচিত? বাবা খুব দেরি করতে লাগলেন। ঝড়বৃষ্টিতে এদিকে সব ভাসিয়ে নিচ্ছে।