বাবা বিয়ে করলে সংসার স্বাভাবিক হলে তো ভালই হয়। নীলু ঠিকই বলেছে, সব বাড়িতে মা জাতীয় একজন কেউ দরকার। সে সময়মত মেয়েদের ব্ৰা কিনে দেবে।
কিন্তু আমার বড় মামা সেদিকটা দেখছেন না। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু-একটা হতে যাচ্ছে। মামা বললেন, খোঁজখবর না রাখায় এটা হচ্ছে। নানান ধান্ধায় থাকি। খোঁজখবর নেই তা ঠিক। মামার বাড়ির সঙ্গে এখন সম্পর্ক নেই বললেই হয়। মামারা অনেকদিন ধরে আসেন না। আগে ঘনঘন আসতেন এবং যতবার আসতেন ততবারই জিদ করতেন। আমাদের দিনাজপুরে নেবার জন্যে। বাবা ব্যবসাপাতির ঝামেলা তুলে এড়িয়ে যেতেন। মা স্পষ্ট বলতেন, তোমাদের বৌদের সঙ্গে আমার বনে না। বাবা মা মারা গেলে বাপের বাড়ি থাকে না। সেখানে যাওয়া যায় না।
বাবা আবার বিয়ে করবেন কি-না এই প্রসঙ্গে বড় মামার এরকম কৌতূহলের কারণ কি আমি ধরতে পারি না। মামাদের সঙ্গে আমার বাবার তেমন আন্তরিকতা নেই। এইসব নিয়েও মার সঙ্গে তার ঝগড়া হত। মা বলতেন, আমার ভাইদের তুমি সহ্য করতে পার না, এর কারণ কি আমাকে বল তো?
সহ্য করতে না পারার কি আছে?
কথা বল না, চুপচাপ থাক।
একেক জনের একেক রকম স্বভাব। আমার স্বভাবই হচ্ছে কথা কম বলা।
দোতলার নজমুল হুঁদা সাহেরের সঙ্গে তো খুব বকবক কর।
আমি বকবক করি না। উনি করেন। আমি শুনি।
আমার ভাইদের সঙ্গে তো তাও কর না।
ওনার বকবকানি শোনা যায়। তোমার ভাইদেরটা শোনা যায় না।
ও–তাই বুঝি?
বাবা চুপ। মা কাটা কাটা গলায় বললেন, বেশ তো আমি ওদের বলব যেন আর না আসে।
মামাদের আসা বন্ধ হয়নি। আমার ধারণা বাবার কাছ থেকে তারা টাকা-পয়সা নিতেন। আমার সব মামারাই ব্যবসা করতেন। টাকার দরকার তাদের লেগেই থাকত। এটা অবশ্যি আমাদের অনুমান। কারণ মামারা হঠাৎ এসে উপস্থিত হলেই মা গম্ভীর মুখে বলতেন, দরকার ছাড়া তো তোদের আসা হয় না, আবার দরকার হয়েছে বুঝি? মামারা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসতেন।
এবারো যখন এলেন সম্ভবত টাকার জন্যেই এলেন। বাবার ব্যবসা পাতির অবস্থা সম্পর্কে খুব ব্যস্ত হয়ে খোঁজখবর শুরু করলেন। আমার ঘরে ঢুকে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন, দুলাভাইয়ের ব্যবসা কেমন চলছে রে?
ভালই বোধহয়। আমি তো এইসব ঠিক জানি না।
না জানলে হবে কেন? খোঁজখবর রাখতে হয়। দুলাভাইয়ের ছেলে নেই। তোদেরই তো খোঁজ করতে হবে। ঠিক না?
আমি চুপ করে থাকি। বড় মামা সিগারেট ধরান একটা। নিচু গলায় বললেন, মনে হল দুলাভাইয়ের ব্যবসা ভালোই হচ্ছে। তোদের গান-বাজনা শেখাচ্ছেন, এসব তো দারুণ খবচান্ত ব্যাপার। হাতি পোষার মতো, লাভ হয় না কিছু।
লাভ হবে না কেন?
আরে দূর, দুই-একদিন সারেগামা করলেই যদি গান হত তাহলে কি আর কথা ছিল নাকি? আমি কোনো উত্তর দিলাম না। বড় মামা হঠাৎ করে বললেন, তোদের এখন শাড়ি পরা উচিত, বুঝলি? তোর আর নীলুর। বড় হয়ে গেছিস।
কথাটা এমন অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলা যে আমি হকচাকিয়ে পেলাম। বড় হয়ে যাচ্ছি। বড় হওয়াটা খুব-একটা কি বাজে ব্যাপার?
রাস্তাঘাটে একা একা চলাফেরা করবি না। ঐদিন দেখলাম সন্ধ্যার পব নীলু বাড়ি আসল।
বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল। জন্মদিন।
জন্মদিন-ফন্মদিন যাই হোক একা একা যেন না যায়। সুন্দরী মেয়েদের অনেক রকম যন্ত্রণা।
আমরা সুন্দরী বুঝি?
হুঁ, ইয়ে সুন্দরী তো বটেই। আয়না দিয়ে নিজেদের দেখিস না?
আমি হঠাৎ বলে বসলাম, কে বেশি সুন্দর মামা? আমি না নীলু?
মামা জবাব দিলেন না। তাঁকে খুব বেশি চিন্তিত মনে হতে লাগল।
ক্লাস নাইনের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষাতে নীলু অংক এবং ইংরেজিতে পাস করতে পারল না। অংকে পেল। তেইশ আর ইংরেজিতে একত্রিশ। তাকে খুব বিচলিত মনে হল না। হাসিমুখে বলল, দূর–আমি আর পড়াশুনা করব না।
করবি না তো কি কারবি?
বিয়ে করব।
বিয়ে করবি মানে? কাকে বিয়ে করবি?
বিয়ে করার লোকের অভাব আছে নাকি? আমি হ্যাঁ বললে এক্ষুণি দুতিনটা ছেলে চলে আসবে।
তাই নাকি?
হুঁ, তুই কী ভাবিস আমাকে?
আমি প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, বাবা পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে রাগ করবেন।
রাগ করবার কী আছে? সবাই একরকম হয়? কেউ ভাল করে, কেউ করে না।
বাবা রাগ করলেন না। প্রগ্রেস রিপোটটা দেখলেন অবাক হয়ে।
এ রকম হয়েছে কেন নীলু?
পড়াশুনা করতে আমার ভাল লাগে না বাবা।
আগে তো লাগত।
আগেও লাগত না। জোর করে পড়ড়াম।
ভাল না লাগলেও অনেক কিছু করতে হয় নীলু। তোমাদের জন্যে একজন টিচার রেখে দিলে কেমন হয়?
নীলু কথা বলে না। বাবা বললেন, তোমার কী মনে হয় বিলু মা?
ভালই হবে।
নীলু হালকা স্বরে বলল, এখন থেকে আমি একা একটা ঘরে থাকতে চাই বাবা।
পশ্চিমের ঐ ঘরটা পরিষ্কার করে দিলেই হবে। আমি রমজান ভাইকে বলব।
একা থাকার দরকার কী? তোমার তো আবার ভূতের ভয়।
এখন আমার ভূতের ভয় নেই বাবা।
আমার মনে হয় না। এটা ভাল হবে।
ভালই হবে বাবা।
ঠিক আছে। সেতারা কার সঙ্গে থাকবে?
তোমার সঙ্গে কিংবা বিলুর সঙ্গে।
উঠি চলে গেল। বাবা গন্ধীর হয়ে বললেন, তোর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে?
জি না।
নীলু সারা দুপুর জিনিসপত্র সরিয়ে পশ্চিমের ঘরটা গোছাল। আমি কয়েকবার বললাম, এই–রাত্ৰিবেলা ভয় পাবি। নীলু। কোনো উত্তর দিল না। বিকেলের মধ্যে দেখলাম ঘর তৈরি হয়ে গেছে। একটা খাট। পড়ার টেবিল। আলনা। মায়ের ড্রেসিং টেবিল দিয়ে চমৎকার সাজিয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এক ফাঁকে আমাদের ঘর থেকে মায়ের ছবিটাও নিয়ে গেছে।