আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। অংক আপা আজেবাজে প্রশ্ন করবেন। কয়েকদিন আগে হাফ টাইমের সময় অংক আপার সঙ্গে দেখা। আপা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, তোমার মা শুনলাম ঐ লোকটার সঙ্গে ইন্ডিয়া চলে গেছে, সত্যি নাকি?
না সত্যি না।
কোথায় আছে তাহলে?
আমি চুপ করে রইলাম।
আপা গলা নিচু করে বললেন, বলতে পার না, না?
সিরাজগঞ্জে আছেন।
ও বাচ্চাকাঁচা হয়েছে নাকি?
আমি জানি না আপা?
আমাকে কে যেন বলল একটা ছেলে হয়েছে।
আমার নিজের ধারণা মেয়েদের মতো হৃদয়হীন পুরুষরা হতে পারে না। ছেলেরা কেউ এখনো আমাকে আমার মা প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। অথচ চেনাজানা মেয়েদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে কিছু জানতে চায়নি।
ক্লাসের বন্ধুদের কথা বাদই দিই, বন্ধুদের মা-খালাদের পর্যন্ত কৌতূহলের সীমা নেই। কোনো না কোনো ভাবে টেনেন্টুনে ঐ প্রসঙ্গ আনবেই।
বিলু তোমরা আগে কিছু টের পাওনি? আগেই তো টের পাওয়া উচিত।
তোমার মা নাকি যাবার আগে বহু টাকা-পয়সা নিয়ে গেছে?
মা গিয়েছেন প্রায় দুবছর আগে। এখনো কেউ সেটা ভুলতে পারে না কেন কে জানে?
অংক ক্লাসটা আমার খুব খারাপভাবে কাটল। ক্লাস শেষ হওয়া মাত্র গেলাম। আপার কাছে। আপার নিজের কোনো ঘর নেই। কমন রুমে একগাদা টিচারের সঙ্গে বসে আছেন। তিনি আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললেন, তোমাদের বাড়িতে বয়স্ক মহিলা কেউ নেই?
কাজের একটি মেয়ে আছে। আকবরের মা।
সে ছাড়া কেউ নেই?
জি না আপা। কেন?
তোমরা তো বড় হচ্ছে এখন, কিছু কিছু জিনিস তোমাদেব বলা দরকার, কেউ বলছে না। তাই তোমাকে ডাকলাম।
আমি আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আপা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, বিলু তোমার এবং নীলুর দুজনেরই এখন ব্ৰা পরা উচিত।
আমি চোখ-মুখ লাল করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
তোমার বাবাকে বলবে কিনে দিতে। বাবাকে বলাব মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। আর যদি লজ্জা লাগে তাকে আমি একটি চিঠি লিখে দিতে পারি।
দিন, একটা চিঠি লিখে দিন।
ঠিক আছে, ক্লাস ছুটির পর চিঠি নিয়ে যেও। আরেকটি কথা, নীলু। মোটেই পড়াশোনা করছে না। তোমার বাবাকে বলবে কোনো প্রাইভেট টিচার রেখে দিতে। অংকে সে খুব কাঁচা। অংক জানে না বললেই হয়।
আপা আমি বলব।
আছে তুমি যাও এখন। এই সব বললাম দেখে কিছু মনে করনি তো?
জি না।
মনে হচ্ছে তুমি আমার ওপর রাগ করেছ। রাগ করার কিছু নেই বিলু। তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি। এত ঝামেলার মধ্যেও যে মেয়ে প্রতি বিষয়ে সবচে বেশি নাম্বার পায় তার প্রশংসা তো করতেই হয়।
অংক আপা একটু হাসলেন।
বিলু?
জি।
কখনো কোনো অসুবিধা হলে আমাকে বলবে।
ঠিক আছে আপা বলব।
শোন আরেকটা কথা। ইয়ে কি যেন বলে তোমার বাবা-নাকি আবার বিয়ে করছেন?
জি না।
তুমি বোধহয় জানো না। বাবার বিয়ের কথা তো মেয়েদের জানার কথা নয়।
বাবার বিয়ের কথা কিছুদিন থেকেই শোনা যাচ্ছে। দিনাজপুর থেকে বড় মামা এসেছিলেন। তিনি পর্যন্ত নিলুকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করেছেন, দুলাভাই নাকি বিয়ে করছেন? নিলু তার স্বভাবমত হেসে ভেঙে পড়েছে।
হাসছিস কেন?
হাসির কথা বললে হাসব না মামা?
আমি কি হাসির কথা বললাম নাকি? বিয়ে করলে তোদের অবস্থাটা কি হবে ভেবেছিস?
কি আর হবে। আমার তো মনে হয়। ভালই হবে। কথা বলার একজন লোক পাওয়া যাবে।
কথা বলার লোকের তোর অভাব?
হ্যাঁ মামা। বিলুর সঙ্গে কি আর কথা সব বলা যায়? মা জাতীয় একজন কেউ লাগে। বাবা বিয়ে করলে ভাল হয় মামা।
করছেন নাকি?
জানি না মামা। তবে দোতলার নজমুল চাচা একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা এখন একটা বিয়ে করলে মনে হয় সংসার স্বাভাবিক হয়।
তুই কি বললি?
আমি বললাম, তা তো ঠিকই।
মামা গম্ভীর হয়ে পড়লেন। নীলু বলল, তারপর একদিন এক বুড়োমত ভদ্রলোক এসে বাড়িটাড়ি ঘুরেটুরে দেখলেন। মার সঙ্গে বাবার সম্পর্ক কি রকম ছিল জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করলেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ মামা, বিয়ে বোধহয় লেগে যাচ্ছে।
নীলু খিলখিল করে উঠল। আমি নিজেও অবাক হলাম। এসব কিছুই আমি জানি না। নীলু আজকাল অনেক কথাই আমাকে বলে না। প্রায়ই সে তার বান্ধবীর বাড়ি যাচ্ছে হঠাৎ করে তার সঙ্গে এত খাতির হল কেন–জিজ্ঞেস করাতে সে গা এলিয়ে হোসেছে। এ বাড়ির সবাই বদলে যাচ্ছে। বাবা বদলেছেন সবচেয়ে বেশি। আমাদের জন্মদিন গেল। জুন মাসের দশ তারিখ। বাবা কোনো কবিতা লিখলেন না। কয়েকদিন আগে দেখলাম সেতারাকে কি জন্যে যেন ধমকাচ্ছেন। সেতারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বাবার এরকম আচরণ তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। বাড়িও ফিরছেন। আজকাল অনেক রাতে। গতকাল বাড়ি ফিরলেন সাড়ে এগারোটার দিকে। আমি জেগে বসে ছিলাম। বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, এত রাত পর্যন্ত জেগে বসে আছ কেন? আর থাকবে না। দশটা বাজতেই ঘুমাতে যাবে।
আমি শান্ত স্বরে বললাম, তুমি আমার সঙ্গে এত রেগে রেগে কথা বলছ কেন?
রেগে রেগে কথা বলছি নাকি?
আমি উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম। বাবা খাওয়া-দাওয়ার পর আমার ঘরে পাশের জানালার ধারে এসে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, এই বিলু, বিলু। আমি ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম। বাবা বেশ খানিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন।
বাবা এরকম ছিলেন না, বাবা বদলে যাচ্ছেন। নীলু। তো বদলে গেছে। আমি নিজেও বোধহয় বদলাচ্ছি। একা একা থাকতে ইচ্ছে করে। সেদিন খুব ঝগড়া করলাম নীলুর সঙ্গে। আমি মাঝে মাঝে অচেনা সব মানুষদের মন গড়া চিঠি লিখি, নীলু। সেটা জানে। তবু সে একটা চিঠি হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, প্রেমপত্র নাকি রে? তারপর মুখ বাঁকা করে পড়তে শুরু করল–আপনাকে একটি কথা বলা হয়নি। এখন শ্রাবণ মাস তো, তাই খুব বৃষ্টি হচ্ছে। রাতদিন ঝমঝম বৃষ্টিশ নীলু। বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, শ্রাবণ মাস কোথায় রে, এটা তো আশ্বিন মাস। তোর মাথাটা খারাপ। হি-হি-হি। আমি চিঠি কেড়ে নিয়ে নীলুর গালে একটা চড় কষিয়ে দিলাম। নীলু দারুণ অবাক হয়ে গেল। আমি এরকম ছিলাম না।