আমাদের ঘরে মা-বাবা এবং আমাদের তিন জনের যে ছবিটি ছিল সেটি শুধু বাবা সরালেন না। রান্নাবান্না করবার জন্যে রমজান নামের একজন বুড়ো মানুষ রাখা হল। এই লোকটি এসেই প্রচণ্ড ঝগড়া শুরু করল আকবরের মার সঙ্গে। দুজনেরই কি ঝাঁঝাল কথাবার্তা। কিন্তু রমজান লোকটি ভাল। সে সেতারাকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভাত খাওয়াত। আমাদের ওপর তার খবরদারিরও সীমা ছিল না।
এই সইন্ধ্যা রাইতে বাগানো ঘুরাঘুরি করণ ঠিক না।
অত তেঁতুল খাওন বালা না, বুদ্ধি নষ্ট হয়।
ভাত খাওনের আগে বিসমিল্লা কইরা এট্টু লবণ মুখের মইধ্যে দেওন দরকার।
রাতের বেলায় খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে সে গম্ভীর হয়ে একটা খবরের কাগজ নিয়ে আমাদের পড়ার ঘরে গিয়ে বসত। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে এমন সব কথাবার্তা বলত যে নীলু হেসে উঠত খিলখিল করে।
হুঁ খুব সংকটময় অবস্থা। বুঝছি নীলু আপা, অবস্থা সংকটময়।
কেন?
নেপালে পাহাড়ি ঢল। হুঁ।
এই অবস্থায় ঝগড়া লেগে যেত আকবরের মার সঙ্গে, আকবরের মা কোমরে দুই হাত দিয়ে রণরঙ্গিনী মূর্তিতে এসে দাঁড়াত।
বিদ্যার জাহাজ যে বইছেন পাকঘরের বাসনডি কেডা ধুইব?
চুপ থাক। অশিক্ষিত মূর্খ মেয়ে মানুষ, এদের নিয়ে চলাফেরা মুশকিল।
রমজান ছাড়াও একজন ভয়ংকর রোগা দাঁত নেই ওস্তাদ রাখা হল। এই ওস্তাদটির নাম মুনশী সোভােহান। তিনি আমাদের তিন বোনকে সপ্তাহে তিন দিন গান শেখাবেন। আমরা তিন জনেই গান শিখতে শুরু করলাম। সকাললো হরমোনিয়াম নিয়ে বসে সারেগা রেগামা গামাপা। খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার। ওস্তাদ সোভােহান বেশিক্ষণ গান শেখাতে পারেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাঁপানির টান ওঠে। গান থামিয়ে বলেন, ঘরে কোনো টিফিন আছে কিনা দেখ তো খুকি। না থাকলে একটা মুরগির ডিম ভেজে দিতে বল। হাসের ডিম না। হাসের ডিম গন্ধ করে, খেতে পারি না।
গানের ওপর থেকে আমাদের মন উঠে গিয়েছিল, কাজেই আমাকে দিয়ে গান হল না। সেতারা এবং নীলু। শিখতে লাগল। কিছুদিন পর নীলুও কেটে পড়ল। রইল। শুধু সেতারা। মাস ছয়েকের মধ্যে দেখা গেল বেণী দুলিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সেতারা গাইছে, নবীর দুলালী মেয়ে খেলে মদিনায়। ও ও ও খেলে মদিনায়।
ওস্তাদ সোভাহান ঘাড়-টান দুলিয়ে বলেছেন, মারহাবা মারহাবা কি টনটনে গলা। এইবার লক্ষ্মী ময়না গিয়ে দেখ তো কোনো টিফিন আছে কিনা। না থাকলে মধুর দোকান থেকে যেন একটা আমৃত্তি নিয়ে আসে। আর চা দিতে বল।
সে বছর শীতের সময় মা আমাদের তিন বোনকে সিরাজগঞ্জ থেকে আলাদা আলাদা চিঠি লিখলেন। বাবা একদিন সন্ধ্যায় পাংশুমুখে তিনটি খামে বন্ধ চিঠি নিয়ে আমাদের ঘরে এসে দাঁড়ালেন। কাঁপা গলায় বললেন, তোমাদের মা চিঠি লিখেছেন। তোমরা কি সেই চিঠি পড়তে চাও?
বাবার গলা কাঁপছিল। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। বাবা চাচ্ছেন আমরা বলি, না। বাবা কপালের ঘাম মুছে নিচু স্বরে বললেন, আমরা সবাই তাকে ভুলতে চেষ্টা করছি। এখন আবার চিঠিপত্র শুরু করলে কষ্ট হবে। নতুন করে কষ্ট হবে।
বাবা থামতেই সেতারা বলল, আমার চিঠি দাও। খানিকক্ষণ চুপ থেকে নীলু বলল, আমার চিঠিটাও দাও। শুধু আমি কিছুই বললাম না। বাবা ধরা গলায় বললেন, মামণি রাত্রি, তোমারটা?
আমি চাই না।
কি লেখা ছিল নীলু এবং সেতারার চিঠিতে আমি জানি না। নীলু। সমস্ত কথাই আমাকে বলে। শুধু চিঠির ব্যাপারে কিছু বলল না। আর সেতারা তো তার খামই খুলল না। বন্ধ খাম হাতে নিয়েই ঘুরে বেড়াতে লাগল।
আমি বললাম, খুলে দেব?
না।
না খুললে পড়বি কি করে?
আমি পরে পড়ব।
যেন পড়লেই চিঠির মজা শেষ হয়ে যাবে। আমি সমস্ত দিন ভাবলাম কি লিখেছেন মা চিঠিতে? ক্লাসে আপারা কি পড়ালেন কিছুই বুঝতে পারলাম না। অংক আপা দুবার ধমক দিলেন, এই বিলু তোমার পড়ায় আজকে মন নেই, কি ব্যাপার?
কিছু না আপা।
আমি কি বলছি তুমি তো কিছুই শুনিছ না।
শুনছি আপা।
না শুনিছ না। বল তো আমি কি বলছিলাম?
আমি বলতে পারলাম না। সব মেয়েরা হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমার ক্লাসের মেয়েরা বিচিত্র কারণে আমাকে অপছন্দ করে। সব সময় আমার পেছনে লেগে থাকে। আমাদের বাথরুমের দেয়ালে আমাকে নিয়ে অনেক কথাবার্তা লেখা। একটা নেংটা মেয়ে এবং একটা নেংটা ছেলের ছবি আঁকা আছে। মেয়েটার গায়ে লেখা বিলু ক্লাস নাইন খ শাখা। অথচ কোথাও নীলুর নামে কিছু লেখা নেই। আমি কখনো বাথরুমে যাই না। যদি যেতেই হয় তাহলে অনেকক্ষণ সেখানে বসে কাদি। ইরেজার দিয়ে লেখাগুলি তুলে ফেলতে চেষ্টা করি–কিছুতেই সেগুলি উঠানো যায় না।
বিলু মন দিয়ে পড়াশুনা করবে, বুঝলে। এরকম করলে তো হবে না।
ক্লাসের মেয়েগুলি আবার হৈচৈ করে হেসে উঠল। বাড়িতে ফিরে এসে অনেকক্ষণ একা একা বসে রইলাম। রাতে রমজান ভাইকে বলে দিলাম, ক্ষিধে নেই, কিছু খাব না। অনেক রাতে ঘুমাতে গিয়ে দেখি আমার-বালিশ্রের নিচে মায়ের পাঠানো খামটা রেখে দেয়া। নিশ্চয়ই বাবার কাণ্ড।
ঘরে কেউ নেই। নীলু এখনো পড়ছে। সেতারা রান্নাঘরে রমজান ভাইয়ের সঙ্গে কি যেন করছে। আমি দরজা বন্ধ করে খাম খুলে ফেললাম। মা আমাকে বিলু নামে সম্বোধন করেননি, প্রথমবারের মত লিখেছেন রাত্রি।
মামণি রাত্রি,
আমি জানি রাগ করেছ তুমি। কিন্তু কি করব মা। উপায় ছিল না। তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে। মানুষের মন খুব বিচিত্র জিনিস। একবার কোনো কিছুতে মন বসে গেলে তা ফেরানো যায় না। আমি বহু চেষ্টা করেছি। মানুষ হয়ে জন্মানোর মতো কষ্টের কিছু নেই। আমি তোমাদের ছেড়েছুড়ে এসেছি। তবু রাতদিন তোমাদের কথাই ভাবি। রাতদিন প্রার্থনা করি যে কষ্ট আমি পাচ্ছি। তা যেন কখনো আমার মামণিদের না হয়।
–তোমার মা।
থার্ড পিরিয়ডে অংক আপা
থার্ড পিরিয়ডে অংক আপা ক্লাসে ঢুকেই বললেন, বিলু ক্লাস শেষে আজি তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে।