আমরা স্কুলে গিয়েছি। থার্ড পিরিয়ডে জিওগ্রাফি আপা এসে বললেন, নীলু বিলু তোমরা দু’জন বাসায় যাও তো, তোমাদের নিতে এসেছে। আমরা অবাক হয়ে বাসায় এসে দেখি আকবরের মা সেতারাকে ঘুম পাড়াচ্ছে, বাসায় মা-বাবা কেউ নেই। দোতলার নজমুল চাচা শুধু বসার ঘরে মুখ কালো করে বসে আছেন। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা অদ্ভুত কথা শুনলাম। মা নাকি ম্যানেজার কাকুর সঙ্গে কোথায় চলে গেছেন। আর আসবেন না–এ রকম একটা চিঠি লিখে গেছেন।
বাবা ফিরলেন রাত এগারোটায়। আমরা জেগে বসে আছি। অনেক লোকজন এসেছে। কেউ যাচ্ছে না। সবাই গম্ভীর মুখে বসে আছেন বসবার ঘরে। বাবা ঘরে ঢুকে এমন ভাব করলেন যেন কিছুই হয়নি। হাসিমুখে বললেন, রেণু ঝগড়া করে সকালের ট্রেনে দিনাজপুর তার বাবার বাড়ি চলে গেছে। আমি ছিলাম না। ভাগ্যিস প্রণব বাবু বুদ্ধি করে সঙ্গে গেছেন। নয়তো একা এক মেয়েছেলে এত দূর যাবে, দেখেন না অবস্থাটা। এই মেয়েজাতটার মত রাগ আর কারোর নেই। হা হা হয়। এদের নিয়েও চলে না। না নিয়েও চলে না।
লোকজন সব বারটার মধ্যে চলে গেল। আমরা নিজেদের ঘরে চুপচাপ শুয়ে ছিলাম। বাবা এসে ঘরে ঢুকলেন।
মামণিরা ঘুমাচ্ছ?
আমরা কেউ জবাব দিলাম না। বাবা মৃদু স্বরে বললেন, আজ রাতে তোমরা আমার সঙ্গে ঘুমাবে মামণিরা?
নীলু শব্দ করে কেঁদে উঠল।
সে সময় আমার এবং নীলুর বয়স বার, সেতারার সাত।
মা চলে গিয়েছেন
মা চলে গিয়েছেন এবং আর কোনোদিন ফিরে আসবে না— এটা আমরা খুব সহজেই বুঝে ফেললাম। শুধু সেতারা বুঝতে চাইল না। সে এমনিতেই কম কথা বলে। এখন কথাবার্তা পুরোপুরি বন্ধ করে দিল। দিনরাত সে শুধু মাকে খুঁজত। মার শোবার ঘরের সামনে কতবার যে গিয়ে দাঁড়াত। ডাকাডাকি না কিছু না, শুধু দরজার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা। আমি একদিন দেখতে পেয়ে ডাকলাম, এই সেতারা।
উঁ।
এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
সেতারা মাথাটা অনেকখানি নিচু করে ফেলল যেন খুব-একটা অপরাধ করেছে।
কি করছিস তুই?
কিছু না।
আয় আমার সাথে নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করব, আসবি?
না।
আমি লক্ষ্য করি সে একা একা ঘুরে বেড়াতে চায়। কারো সঙ্গে থাকতে চায় না। সন্ধ্যাবেলা কেউ কিছু বলার আগেই সে আমার সাথী বই নিয়ে বসে একদম নিচু স্বরে পড়তে থাকে
‘কমলাফুলি কমলা ফুলি
কমলা লেবুর ফুল
কমলা ফুলির বিয়ে হবে
কানে মোতির দুল।’
যখনি সে পড়তে বসে এই একটি কবিতাই সে পড়ে। তখন যদি বাড়ির সামনে কোনো রিকশা। এসে থামে সে পড়া বন্ধ করে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। এক সময় বই বন্ধ করে অপরাধীর মত আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে চলে যায় বারান্দায়। আবার ফিরে এসে পড়তে বসে–কমলাফুলি, কমলাফুলি কমলা লেবুর ফুল…।
একদিন নীলু বলল, সেতারা মা আমাদের কাউকে পছন্দ করেন না তো তাই চলে গেছেন। আর আসবেন না।
আচ্ছা।
যে আমাদের ভালবাসে না। আমরাও তাকে ভালবাসি না, ঠিক না?
হুঁ।
তুই আর মাকে খুঁজবি না–আচ্ছা?
সেতারা মৃদু স্বরে বলল, আমাদের পছন্দ করে না কেন?
আমরা সবাই তো মেয়ে এই জন্যে, ছেলে হলে পছন্দ হত। আমাদের তো কোন ভাই নেই। বুঝেছিস?
হুঁ।
সেতারা মায়ের আদর পায়নি বললেই হয়। তার জন্মের পর পর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেতারা বড় হতে থাকে আকবরের মার কোলে। মার অসুখ যখন সারল তখনো অবস্থার পরিবর্তন হল না। মা মাঝে মাঝেই বিরক্ত স্বরে বলতে লাগলেন, ঘর ভর্তি হয়ে যাচ্ছে মেয়ে দিয়ে, ভাল লাগে না। সেতারা যখন হাঁটতে শিখল, টুকটুক করে হাটত। মায়ের ঘরে গিয়ে দাঁড়াত সুযোগ পেলেই। মা গভীর গলায় ডাকতেন, আকবরের মা ওকে নিয়ে যাও তো, এখুনি ঘর নোংরা। করবে। তার দুবছর বয়স হতেই মা ওকে পাঠিয়ে দিলেন আমাদের ঘরে। রাতে ঘুমাবে নীলুর সঙ্গে। দুধ খাবার জন্যে কাঁদলে আকবরের মা উঠে দুধ বানিয়ে দেবে। সেতারা তখন কোনো ঝামেলা করেনি। এখনো করে না। নীলুর গলা জড়িয়ে ঘুমায়। নীলু বলে, গল্প শুনবি?
বল।
এক দেশে ছিল এক রাজা। তার দুই রানী দুয়ো ও সুয়ো…
এ পর্যন্ত আসতেই সেতারার চোখ বুজে আসে। কোনোদিন আর সে গল্প শেষ পর্যন্ত শোনা ट्र म्षी।
ইদানীং বাবা সেতারাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমাতে চান। সেতারাও বেশ ভাল-মানুষের মত যায়।
কিন্তু মাঝরাতে একা একা চুলে আসে আমাদের ঘরে। রোজ এই কাণ্ড। একরাতে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল, সেতারা সবাইকে ডাকতে লাগল, মা এসেছে রিকশা নিয়ে। আমরা ধড়মড় করে উঠে বসলাম, কোথায়?
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম।
বলিস কি?
হৈচৈ শুনে বাবা উঠে এলেন। কোথায় কি, খা-খা করছে চারদিক! সেতারা দারুণ অবাক হল। বাবা বললেন, স্বপ্ন দেখেছি মা।
উঁহু, স্বপ্ন না। আমি দেখলাম।
সেতারা চোখ বড় বড় করে সবার দিকে তাকাতে লাগল। সে ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছে না। বাবা সেতারাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন। সে রাতে আমি এবং নীলু এক খাটে ঘুমাতে গেলাম। এবং অনেক রাত পর্যন্ত দুজনেই নিঃশব্দে কাদলাম। অথচ দু’জনই এমন ভাব করতে লাগলাম যেন ঘুমিয়ে পড়েছি।
ধীরে ধীরে অনেকগুলি পরিবর্তন ঘটল বাড়িতে। বাবা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি পরিবর্তনগুলি করলেন খুব সাবধানে। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি মার আলনায় কোনো কাপড় নেই। সব বাবা কোথায় সরিয়ে ফেলেন। তার দিন সাতেক পর বারান্দায় মার যে বড় বাধাই করা ছবিটি ছিল সেটিকে আর দেখা গেল না। বাবা-মার শোবার ঘরে তাদের বেশ কয়েকটি ছবি ছিল, সেগুলিও সরানো হল।