প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমরা বেড়াতে বের হলাম। বাবার কাঁধে ফ্লাস্ক। আমরা তিন বোন হাত ধরাধরি করে তাঁর পিছু পিছু যাচ্ছি। কুয়াশায় চারদিক ঢাকা। দেখার মতো কিছুই নেই। নদীটিও শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। বাবার উৎসাহ মিইয়ে এসেছে। মৃদু স্বরে বললেন, ফিরে যাবি নাকি? নীলু বলল, কোথাও বসে চা শেষ করি। এত কষ্ট করে ফ্লাস্কটা আনলে। কোথাও বসার মত জায়গা পাওয়া গেল না। সব শিশিরে ভিজে আছে। বাবা অত্যন্ত বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। সেই আমাদের শেষবারের মতো যাওয়া।
বাবা সুস্থ থাকলে বাবাকে নিয়ে আসা যেত। তিনি আমাদের তিন বোনকে বেরুতে দেখে আগ্রহ নিয়ে বলেছিলেন, কোথায় যাচ্ছিস তোরা? সেতারা বলেছে, নদীর পাড়ে হাঁটতে যাচ্ছি। বাবা। তিনি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, ভাল, খুব ভাল।
বেশিক্ষণ থাকব না। যাব। আর আসব।
যতক্ষণ ইচ্ছা থাকিস মা। আমার জন্যে ভাবতে হবে না। আমি ভালোই আছি। খুব ভাল।
আমরা হাঁটছি নিঃশব্দে। অনেকেই কৌতূহলী হয়ে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। দু’একজন বুড়োমত ভদ্রলোক সেতারাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাল আছ?
নীলু বলল, সেতারাকে সবাই চেনে। ইস আগে যদি মন দিয়ে গানটা শিখতাম।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে শহরের শেষপ্রান্তে চলে এলাম প্ৰায়। সেখানে প্রকাণ্ড একটা ঝাঁকড়া রেন্টি গাছ। তার শিকড় নেমে গেছে নদীর দিকে। কয়েকজন কলেজের ছেলে-টেলে হবে গাছের গুড়ির ওপর বসে সিগারেট টানছিল। ওরা আমাদের দেখেই উঠে দাঁড়াল। একজন এগিয়ে এসে বলল, আপনারা বসবেন?
নাহ।
বসুন না একটু আমাদের সঙ্গে। বসুন।
সেতারা বলল, কিন্তু আপনারা গান গাইতে বলতে পারবেন না।
সব কটি ছেলে একসঙ্গে হেসে উঠল। আমরা তিন বোন পাশাপাশি বসলাম। ছেলেগুলি বসল। আমাদের সামনে।
নীলু বলল, আপনারা রোজ এখানে আসেন? জায়গাটা খুব সুন্দর।
ছেলেগুলি কোনো উত্তর দিল না।
সেতারা বলল, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাড়ি যাওয়া দরকার।
আমরা আপনাদের পৌঁছে দেব। আমরা উত্তর দীঘির পাশ দিয়েই রোজ যাই।
আমরা বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। ছেলেগুলি সেতারাকে গান গাইতে বলল না। কিন্তু সেতারা নিজ থেকেই গুনগুন করতে শুরু করল। খোলা মাঠ। অদূরেই শীর্ণকায় ব্রহ্মপুত্র। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। পাখিরা ডানা ঝাপটাচ্ছে গাছে গাছে। এর মধ্যে সেতারার কিন্নর কণ্ঠ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল—
‘চাহিতে যেমন আগের দিনে
তেমনি মদির চোখে চাহিও
যদি গো সেদিন চোখে আসে জল
লুকাতে সে জল করিও না ছল…’
আমাদের তিন বোনের চোখ ভিজে উঠল। আমরা কতগুলি অপিরিচিত ছেলেকে সামনে বসিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। কান্নার মতো গভীর তো কিছু নেই। একজনের দুঃখ অন্যজনকে স্পর্শ করে না। কিন্তু একজনের চোখের জল অন্যকে স্পর্শ করে। ছেলেগুলি দেখলাম। একে একে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাচ্ছে। পুরুষরা তাদের চোখের জল মেয়েদের দেখাতে চায় না।
একটি ছেলে কোমল স্বরে বলল, আরেকটা গাইবেন?
কোনো অলৌকিক জগৎ থেকে সেতারার গান আসে? বুকের মধ্যে প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে শুনলাম সে গাইছে, ‘নহে নহে প্রিয়, এ নয় আঁখি জল।’
ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যা মিলিয়ে এল। ব্রহ্মপুত্রের ওপর দিয়ে উড়ে আসতে লাগল শীতল হাওয়া। অন্ধকার ঝোপগুলিতে চিকমিক করতে লাগল জোনাকী। ছেলেগুলি আমাদের বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল। সেতারা বলল, ভেতরে আসবেন?
জি না, জি না।
কিন্তু ওরা চলেও গেল না। গোটে বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ।
একজন মৃদু স্বরে বলল, আপনার বাবার শরীর কী এখন ভাল?
নীলু বলল, একটু ভাল।
কিন্তু বাবার শরীর ভাল নয়। আমি জানি বাবা মারা যাবেন খুব শিগগিরই। মৃত্যু টের পাওয়া যায়। তার পদশব্দ ক্ষীণ কিন্তু অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। বাবা মারা যাবার পরপরই আমরা একা হয়ে যাব। কেউ কি তখন এগিয়ে আসবে আমাদের কাছে? একমুখ দাড়িগোফ নিয়ে রকিব ভাই হাসিমুখে বলবেন-কে বিলু আর কে নীলু? গাঢ় ভালবাসার সুবিশাল বাহু প্রসারিত করবে। আমাদের দিকে। হয়ত করবেন, হয়ত করবেন না। এখানে কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না।
বসবার ঘরে বাতি জ্বলছিল। আমরা ঘরে ঢুকেই দেখলাম আমাদের লাল রঙের সোফাটিতে মা বসে আছেন। কেমন অদ্ভুত একটি শান্ত বিষন্ন ভঙ্গি। মা মাথা নিচু করে বললেন, তোমাদের বাবাকে দেখতে এলাম। নজমুল সাহেব টেলিগ্রাম করেছিলেন।
মার পরনে সাদার উপর নীল নকশার একটা শাড়ি। মাথায় আঁচল দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। বয়সের ছাপ পড়েছে চোখে-মুখে। কাপালের কাছে এক গোছ রুপালি চুল। তবুও কি চমৎকারই না লাগছে তাকে।
মা বললেন, তোমরা কেমন আছ?
কেউ কোনো জবাব দিলাম না। মা কি আমাদের তুমি করে বলতেন না তুই কবে বলতেন কিছুতেই মনে পড়ল না।
সবাই অনেক বড় হয়ে গেছে। এবং খুব সুন্দর হয়েছ সবাই। বস। কথা বলি তোমাদের সঙ্গে।
আমরা বসলাম।
মা বললেন, তোমরা নাকি নদীর পাড়ে গিয়েছিলে?
আমরা সে কথার জবাব দিলাম না।
মা থেমে থেমে বললেন, কয়েকদিন আগে সেতারার গান শুনলাম রেডিওতে। বিশ্বাসই হয় নি। আমার একটি মেয়ে এত সুন্দর গান গায়।
সেতারা তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। কিছু-একটা দেখতে চেষ্টা করছে মার মধ্যে। নিজের মনের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছে হয়ত।
তুমি মা খুব নাম করবে। দেশের মানুষের ভালবাসা তুমি পাবে এখনই অবশ্যি পেয়েছ, আরো পাবে।
নীলু বলল, আপনি কখন এসেছেন?