তাই দেখছি।
কি যে ঝামেলা গেছে তুই তো জানিস না। তোকে জানানো হয়নি।
তা জানাবি কেন, আমি কে?
তাও ঠিক।
নীলু হাসল।
আমি বললাম–তুই খুব সুন্দর হয়ে গেছিস নীলু নীলু কিছু বলল না। অন্য সময় হলে সে কিছু-একটা ঠাট্টার কথা বলত। আজ দেখলাম লজ্জা পাচ্ছে।
নীলু তুই কেমন অন্য রকম হয়ে গেছিস।
অন্য রকম মানে কী রকম?
তোর মধ্যে কেমন একটা মা মা ভাব চলে এসেছে।
নীলু এবারও লজ্জিত ভঙ্গিতে আবার হাসল। সত্যি সত্যি সে বদলে গেছে। কিন্তু এই নীলুকেও ভাল লাগছে। আমি মৃদু স্বরে বললাম, আজ রাতে আমরা দু’জন একসঙ্গে শোব, কেমন নীলু?
ঠিক আছে।
সারারাত গল্প করব।
নীলু হাসল। ছোট বোনদের পাগলামী কথাবার্তা শুনে বড় বোনটা যেমন প্রশ্রয়ের হাসি হাসে সে রকম হাসি। ওরা আমার ঘরটি ঠিক আগের মতো করে সাজিয়ে রেখেছে। টেবিলের ওপর বইপত্র যা ছিল সব সে রকমই আছে। একটা বাজারের লিস্ট করেছিলাম, সেই লিস্টটা পর্যন্ত বুলিয়ে রেখেছে।
আমার বিছানায় এখন কে শোয় নীলু? সেতারা?
হুঁ সেতারা বুঝি সে রকম? ও এখনো আমার সঙ্গে ঘুমায়। আরো অনেক মজার ব্যাপার আছে সেতারার।
সেতারা বলল, ভাল হবে না। আপা।
আমি বললাম, কী ব্যাপার?
সেতারাকে কে যেন প্ৰেমপত্র লিখেছে। রুল টানা কাগজে।
নীলু খিলখিল করে হেসে উঠল। কে বলবে এই বাড়িতে কোনো দুঃখ-কষ্ট আছে?
নিলু বলল, নজমুল চাচা তাঁর মেয়ের কাছে যাচ্ছেন জানিস?
না তো।
সামনের মাসের মাঝামাঝি যাবেন। ওর মেয়ের কি যেন একটা অপারেশন হবে। গল ব্লাডার না কি যেন, ঠিক জানি না। মেয়ে বাবার জন্যে টিকিট পাঠিয়েছেন।
নজমুল চাচা নিশ্চয়ই খুব খুশি?
না, খুব না। এত দূর একা একা যেতে ভয় পাচ্ছেন।
ভয়ের কি?
কি জানি চাচার হেনতেন। কত কথা, আসলে যাবার ইচ্ছা নেই।
যাচ্ছেন তো?
তা যাচ্ছেন।
নজমুল চাচার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। নজমুল চাচা আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে লাগলেন। যেন আমি তার হারিয়ে-যাওয়া একটি মেয়ে, কোনোদিন ফিরে পাবেন ভাবেননি, হঠাৎ ফিরে পেয়েছেন। তার কাণ্ড দেখে দরজায় পাশে দাঁড়িয়ে নীলু হাসতে লাগল। চাচা রাগী গলায় ধমক দিলেন, হাসছিস কেন?
নীলু মুখ টিপে বলল, এমনি হাসছি। কাঁদলে দোষ নেই, হাসলে দোষ।
তুই নিচে যা তো নীলু
ঠিক আছে যাচ্ছি। কিন্তু বিলু ভেবে যাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদা হচ্ছে সে কিন্তু বিলু নয়। আমি বিলু।
নজমুল চাচা হকচাকিয়ে গেলেন। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতে লাগলেন। তাঁর মনে সন্দেহ ঢুকে গেল।
তুই কে নীলু না বিলু?
আমি বিলু।
সত্যি করে বল।
সত্যি বলছি।
না, তুই নীলু বড় ফাজিলে হয়েছিস, যা বিলুকে পাঠিয়ে দে। আমি হাসতে হাসতে নিচে নেমে গেলাম। বাড়িতে এসে বড় ভাল লাগছে।
দোতলার নতুন ভাড়াটেদের সঙ্গেও দেখা হল। নীলু বলেছিল নাকি-স্বরে কথা বলেন। কোথায় কী দিব্যি ভাল মানুষের মত কথাবার্তা। নীলুটা এমন বানাতে পারে। ভদ্রমহিলাকে আমার বেশ পছন্দ হল। তবে একটু কথা বেশি বলেন। আমার সঙ্গে দুতিন মিনিট কথা হল, এর মধ্যে হড়বড় করে একশ গণ্ডী কথা বলে ফেললেন। তবে যে সব মেয়েরা বেশি কথা বলে ওদের মনে কোনো ঘোরপ্যাচ থাকে না। এইটা খুব সত্যি। বেশি কথা বলা মেয়েরা খুব দিলখোলা হয়।
সমস্ত দিন আমি অন্য এক ধরনের ভাল লাগা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। দুপুরে নীল আমাকে বাগানে নিয়ে গেল। পেয়ারা গাছে নাকি ডাসা পেয়ারা হয়েছে। খুব মিষ্টি।
বাগান পরিষ্কার করেছে কে?
দোতলার ঐ ভদ্রমহিলা করিয়েছেন। এখন ভাল লাগছে না?
হুঁ। চমৎকার লাগছে।
এ ভদ্রমহিলা আর তার হ্যাঁসবেন্ড প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা বাগানে বসে চা খান। একদিন দেখি হাত ধরাধরি করে হাঁটছেন। খুব রোমান্টিক।
আমি ঘাসের ওপর বসতে বসতে বললাম, তোর রকিব ভাই আর চিঠি-ফিঠি লেখে না?
নীলু লাল হয়ে বলল, লেখে মাঝে মাঝে।
কী লেখেন?
এই সব আজেবাজে তেমন কিছু না।
তুমি নিশ্চয়ই খুব লিখিস?
নীলু জবাব দিল না।
কী রে, লিখিস না তুই?
লিখি মাঝে মাঝে।
তুই কী লিখিস নীলু?
নীলু চুপ করে রইল।
বল না।
যা মনে আসে তাই লিখি। বাবার কথা লিখি, মার কথা লিখি। তোর কথা সেতারার কথা সবার কথা লিখি।
লিখতে খুব ভাল লাগে?
হুঁ।
আমি একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে হালকা স্বরে বললাম, তোদের বিয়ে হলে বেশ মানাবে। দুজনেই চিঠি লেখার ওস্তাদ।
নীলু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। হয়ত তার চোখে পানি আসছে। চাচ্ছে না। আমি দেখে ফেলি।
সন্ধ্যাবেলা আমরা তিন বোন নদীর পাড়ে হাঁটতে গেলাম। মা যখন ছিলেন তখন আমরা প্রায়ই হাঁটতে আসতাম। প্ৰায় মাইলখানিক হাঁটা হয়ে যেত। এক সময় ক্লান্তিতে পা ভারী হয়ে আসত, তবু মায়ের হাঁটার শেষ নেই।
নীলু বলত, আর পারব না। ক্ষমা চাই। আমি এখানে বসে থাকব, তোমরা যাও। মা বলতেন, অল্প কিছু দূর যাব। সামনেই নদীটা খুব সুন্দর। একই রকম নদী। একই দৃশ্য দুপাশে। তবু কিছু কিছু জায়গায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ কণ্ঠে বলতেন, আহ। কী সুন্দর! তেমন বিশেষ সৌন্দর্যের কিছু আমরা দেখতে পেতাম না। কিন্তু মার মুগ্ধ ভাব আমাদের ও স্পর্শ করত। নীলু হাই তুলে বলত, মন্দ না, ভালই। মা চলে যাবার পর আমরা আর নদীর কাছে আসি নি। না কথাটা ঠিক না। বাবার সঙ্গে এসেছিলাম একদিন। গত শীতে আগের শীতে বাবার হঠাৎ সখ হল আমাদের নিয়ে বেড়াবেন। খুব উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ফ্রাস্কে করে চা নিয়ে যাব। নদীর পাড়ে বসে চা খাব, কী বলিস? আমরা কেউ তেমন উৎসাহ দেখলাম না। শুধু সেতারা খুব উৎসাহ দেখাতে লাগল।