নীলু এমনভাবে ছুটে যেত যেন আড়ালে গিয়ে হেসে বুক হালকা করবে। নীলুটা এমন হয়েছে কেন? এ বাড়িতে সবাই একটু গম্ভীর। সেতারা যার বয়স মাত্র পাঁচ সে পর্যন্ত কম কথা বলে। নীলুকার কাছ থেকে এত কথা বলা শিখল? কার কাছ থেকে অকারণে হাসরি এই অদ্ভুত অসুখ জোগাড় করল?
আমার এবং নীলুর খাট দক্ষিণ দিকের বড় ঘরটায়। নীলু ঘুমায় সেতারাকে সঙ্গে নিয়ে। তার একা এক ভয় করে। আকবরের মা ঘুমায় বারান্দায়। আমরা ডাকাডাকি করলে তার উঠে আসার কথা। সে একবার ঘুমালে নিশ্চিন্ত। সারা রাতে এক সেকেন্ডের জন্যেও জাগবে না। এমনিতে অবশ্যি বলবে, ভইন, আমার সজাগ ঘুম। ইটু শব্দ হইলেই চউখ খোলা। আকবরের মা কোন কাজ ঠিকমত করতে পারে না। প্রচুর মিথ্যা কথা বলে। অনেকবার তাকে বিদায় দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, লাভ হয়নি কিছুই। সে ঘাড় বাঁকিয়ে বলেছে, যাইতাম না। দেহি কেমনে বিদায় দেয়। তামাশা না? এই বুড়ো বয়সে যাইতাম কই?
আকবরের মা রাতে ভাতটাত খেয়ে ঘুমাতে এসে জিজ্ঞেস করে, কইগো মাইয়ারা, ভূতের কিচ্ছা হুঁনতে চাও? নীলু ভীতু সে শুনবে না, কিন্তু যেহেতু আমি শুনি কাজেই তাকেও শুনতে হয়। আকবরের বাপের গপটা কই। শাইলের মইধ্যের লোম খাড়া হইয়া যায় বুঝছনি মাইয়ারা। শীতের সময়। খুব জার। আকবরের বাপের মাছ মারতে যাওনের কথা। আমারে কইল তামুক দে…
নীলু গল্পের মাঝখানে জিজ্ঞেস করে, তুই করে বলত?
তা ঠিক। গরিব মাইনষের কথাবার্তা তুই-তুকারি দিয়া।
আকবরের মার ভাষা ঠিক বোঝা না গেলেও গল্প ধরতে কোনো অসুবিধে হয় না। সব গল্পের শেষে আকবরের বাবা। যার সাহসের কোনো সীমা নেই, একটা ভূতের গলা সাপ্টে ধরে কুমড়ো গড়াগড়ি করবে। এবং সব শেষে ভূতটা জঙ্গল ভেঙে ছুটে যাবে। যাবার সময় বলবে, এঁই বাঁর ছাঁইরা দিলাম। বুঁঝছস? জাঁনে বাঁচলি।
গল্প শেষ হলেই নীলু বলবে, দূর, ভূত আবার আছে নাকি?
আকবরের মা চোখ কপালে তুলে বলবে, এইটা কেমুন বেকুবের মতো কথা কইলা? দেশটা ভর্তি ভূত আর পেত্নীতে। আমার সাথে একবার যাইও আমরার নীলগঞ্জের বাড়িত। নিজের চউক্ষে ভূত দেখবা।
আকবরের মা শুধু যে আমাদের ভূতের গল্প শোনাবার চেষ্টা করে তাই না, মাকেও শোনাতে চেষ্টা করে। সুযোগ পেলেই একটা গল্প টেনে আনতে চায়, বুঝছেন আম্মা, একবার হইল। কি…। মা এক ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন। আজেবাজে গল্প মা একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। শুধু আকবরের মা নয় বাবাকেও এমনিভাবে থামানো হয়, যা বলতে চাও সরাসরি বলতে পার না? এত ফেনও কেন?
ফেনাই নাকি?
হ্যাঁ, ফেনাও। বেশি রকম ফেনাও। যা বলার তা সহজভাবে বলতে পারা উচিত।
ও।
রাগ করলে নাকি আবার?
না। আমি এত সহজে রাগ করি না।
বাবার এই কথাটি খুব সত্যি। বাবা রাগ করতে পারেন না। নীলুর ধারণা বাবা মোটা বলেই রাগ করতে জানেন না। মোটা মানুষদের এই একটা বড় অসুবিধে। কথাটা হয়ত সত্যি। আমাদের স্কুলের মোটা আপাগুলিকে কিছুতেই রাগানো যায় না। আর চিকনা। আপাগুলি কারণ ছাড়াই চিড়বিড়, করছে। আমাদের মা নিজেও রোগা বলেই বোধহয় তার রাগ বেশি। তিনি রাগেন না। শুধু আমাদের প্রেসের ম্যানেজার বাবুর সঙ্গে। তার নাম প্রণব বসু। এর অনেক রকম গুণ আছে। চমৎকার গান গাইতে পারেন। এবং চমৎকার গল্প করতে পারেন। তারচে বড় কথা চমৎকার রসিকতা করতে পারেন। এবং রসিকতাগুলি করেন গম্ভীর মুখে।
যেমন একদিন নীলুকে বললেন, এই নীলু কাল কি হয়েছে জানিস?
না তো কি হয়েছে?
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের যে ওস্তাদ আছেন মুনসি মীর আলি, তিনি কাল জিলা স্কুলের মাঠে রাগ জয়জয়ন্তী গেয়ে দুটি মেডেল পেয়েছেন। একটা বড় মেডেল। একটা ছোট মেডেল। ছোটটা পেয়েছেন গান গাওয়ার জন্যে আর বড়টা পেয়েছেন গান থামানোর জন্যে।
প্রণব বাবুকে আমরা ডাকি ম্যানেজার কাকু। মা ডাকেন ম্যানেজার। বাবা ডাকেন বোস। ভাল কিছু রান্নাটান্না হলে বাবা বলবে, দেখি বোসকে একটা খবর দাও তো। খাওয়া-দাওয়ার পর একটু গান-বাজনা হবে।
ম্যানেজার কাকু অবশ্যি সহজে গান-বাজনা করেন না। তবে যদি ধরে-বেঁধে একবার বসানো যায় তখন গান চলে গভীর রাত পর্যন্ত। আমরা অবশ্যি এত রাত পর্যন্ত থাকতে পারি না। ধমক দিয়ে মা আমাদের নিচে পাঠিয়ে দেন। তবে অনেক রাত পর্যন্ত আমরা জেগে গান শুনি। আমাদের নিজের গান শেখার খুবই সখ। মাকে বেশ কয়েকবার বলতে মা ম্যানেজার কাকুকে বললেন, ওদের একটু গান শেখান না।
ম্যানেজার কাকু গম্ভীর গলায় বললেন, বৌদি ওদের বয়স কম।
কম বয়স থেকেই তো শুনেছি গান-বাজনা শুরু করতে হয়।
উঁহু, সংগীতের জন্যে মমতা ছাড়া কিছু হয় না। সেই মমতোটা অল্প বয়সে হয় না। আপনি যদি শিখতে চান শেখাতে পারি।
রক্ষা কর, এই বয়সে আর আঁ আঁ করতে পারব না।
ম্যানেজার কাকুকে একমাত্র নীলু ছাড়া আমরা সবাই বেশ পছন্দ করি। নীলু। যদিও ম্যানেজার কাকুর রসিকতায় সবচে উঁচু গলায় হাসে কিন্তু আড়ালে বলে, আমার ম্যানেজার কাকুকে ভাল লাগে না।
কেন, ভাল না লাগার কি আছে?
আছে একটা–কিছু। আমি জানি না কি।
নীলু। মাঝে মাঝে এলোমেলো কথাবার্তা বলে এবং সেগুলি সত্যিা হয়ে যায়। সেতারা যেদিন স্ক্রিীড় থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছে সেদিন সকালবেলাতেই নীলু বলেছে, আমি রাতে স্বপ্নে দেখেছি সেতারা খাট থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছে। ম্যানেজার কাকু প্রসঙ্গে নীলুর আশংকাও সত্যি হয়ে গেল।