প্রিয় বিলু,
তোদের হোস্টেলের মেয়েরা ভূত এনেছে শুনে নজমুল চাচা খুব রাগ করেছেন। তিনি বলেছেন তিনি হোস্টেল সুপার এবং প্রিন্সিপ্যালকে চিঠি লিখবেন।
আমাদের দোতলায় নতুন ভাড়াটে এসেছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম নীনা। ভদ্রমহিলা নাকি-স্বরে কথা বলেন। প্রথম দিন বাড়িতে এসে বললেন–বাড়িত খুব বড়। তবে চারদিকে খুব জঙ্গলা। আমি বহু কষ্টে হাসি সামলেছি। তবে ভদ্রমহিলা খুব ভাল। বাবার জন্যে সুপ করে পাঠান। এবং খুব খোঁজখবর করেন। তবে ভদ্রমহিলার শুচিবায়ু আছে। রোজ তিন চারবার ঘর ধোয়া মোছা করেন।
বিলু তোকে এখন একটা কথা বলি–আমি রকিব ভাইয়ের একটা খুব চমৎকার চিঠি পেয়েছি। এত সুন্দর চিঠি যে আমি খুব কাদলাম। কত লক্ষ বার যে পড়লাম। সেই চিঠি। আমার কি ইচ্ছে করে জানিস? ইচ্ছে করে একদিন হুঁট করে ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে খুব চমকে দেই। তারপর তিনি যখন বলবেন—তুমি কে, নীলু না বিলু? আমি তখন বলব, আমি বিলু। এবং অনেকক্ষণ বিলু হিসেবে কথাবার্তা বলার পর হঠাৎ বলব, আমি কিন্তু নীলু ভদ্রলোকের মুখের অবস্থাটা কি হবে ভেবে দেখ।
বিলু, ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে কি করে আমার পরিচয় হল তোকে বলি। মুন্নিদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছি। অপলারাও গিয়েছে। মুন্নি বলল, আমার এক ভাই এসেছেন ইউনিভার্সিটির টিচার। অংকের টিচার, যা গম্ভীর। আমরা আড়াল থেকে দেখলাম সত্যি গম্ভীর। মুন্নি তখন করল কি জানিস? আমাকে বলল–এই নীলু, তুই যদি আমার ঐ ভাইয়ের কাছ থেকে একটা সিগারেট নিয়ে খেতে পারিস তো বুঝব তোর সাহস। আমি বললাম–আমি শুধু শুধু তার কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে খাব কেন?
তুই তো টেনেছিস সিগারেট। স্কুলের বাথরুমে। এখন দেখি তোর সাহস। যদি সিগারেট চাইতে পারিস তাহলে প্রমাণ হবে আমাদের ক্লাসে তোর চেয়ে সাহসী মেয়ে নেই।
আমি ইতস্তত করে ঢুকে পড়লাম ভদ্রলোকের ঘরে। কোনোমতে বললাম–মুন্নির সঙ্গে আমার একটা বাজি হয়েছে। সেই বাজিতে আমি জিতব, যদি আপনি আমাকে একটা সিগারেট দেন।
ভদ্রলোক কিছুই বুঝতে পারলেন না, একটা সিগারেট বের করে দিলেন। আমি বললাম, আপনি রাগ করবেন না। সিগারেটটা আমাকে ধরাতে হবে। ভদ্রলোক দিয়াশলাই বের করে দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমার দিকে। নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি?
নীলু
ও নীলু তোমার কথা বলেছে আমাকে মুন্নি।
কি বলেছে?
বলেছে যে তুমি খুব তেজী মেয়ে।
আরো অনেক কিছু বলেছে নিশ্চয়ই।
ভদ্রলোক তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি বললাম, আর কিছু বলেনি মুন্নি?
আর কি বলবে?
বলেনি আমার মা পালিয়ে গেছে? আমাদের সম্পর্কে যখন কেউ কিছু বলে সেটাই সবার আগে বলে।
ভদ্রলোক চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, মুন্নি বলেনি সে সব?
বলেছে।
আমি দেখলাম জানালার আড়াল থেকে মুন্নি ও অপলা অবাক হয়ে দেখছে আমার হাতে জুলন্ত সিগারেট।
আমি বললাম, আজ উঠি। আপনি আমার ওপর রাগ করেননি তো।
রাগ করব কেন?
আপনার সামনে সিগারেট টানলাম যে।
না। রাগ করিনি। মাঝে মাঝে এই সব ছেলেমানুষি দেখতে ভালই লাগে।
আমি উঠে দাঁড়াতেই ভদ্রলোক বললেন–নীলু বস, তোমার সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভাল লাগছে। প্লিজ বাস। আমি অবাক হয়েই বসলাম। আর আমার কি যে ভাল লাগল। এখনো মনে আছে সে রাতে অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমুতে পারিনি। শেষ রাতের দিকে ঘুম এল এবং আমি ভদ্রলোকেকে স্বপ্ন দেখলাম। যেন আমি চা বানাচ্ছি, তিনি এসে বললেন–নীলু আমার আজ ফিরতে দেরি হবে, তুমি খেয়ে নিও। অপেক্ষা করবার দরকার নেই। আমি রাগের ভঙ্গি করে বললাম।–না। আজ কোথাও যেতে পারবে না। আজ আমরা বাগানে হাঁটব।
অদ্ভুত মিষ্টি স্বপ্নের ভেতরই আমি কেঁদে বুক ভাসিয়েছি। কাউকে এই স্বপ্নের কথা বলতে পারিনি। তোকে বলার ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু সাহস হয়নি। যদি তুই হাসোহাসি করিস।
তোকে আমি অনেক কথা বলতে চাই বিলু। ছুটি হতে তো অনেক দেরি। একবার চালে আয় না। তাছাড়া এমনিতেও তোর আসা উচিত। বাবার শরীর খুব খারাপ, কেউ তোকে জানাচ্ছে না। কাল রাতে আমি ঘরে ঢুকতেই বাবা বললেন, কে রেনু? আমি বললাম–বাবা আমি নীলু বাবা কেমন চোখে তাকালেন আমার দিকে, তারপর বললেন–নীলু, তোর মা বোধ হয় এসেছে। বসতে-টসতে দে। পুরোনো কথা মনে রেখে লাভ নেই।
বিলু চলে আয়।
–তোর
নীলু
বাড়ি ফিরে
বাড়ি ফিরে অবাক হলাম।
সব কিছুই অন্যরকম লাগছে। চারদিকে কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার। সব কিছুই অন্যরকম হয়ে গেছে। সেতারাকেও মনে হল এই তিন মাসে অনেকখানি বড় হয়ে গেছে। সবচে বদলেছেন বাবা। কী যে খারাপ হয়েছে তার স্বাস্থ্য। চোখ হলুদ। মাথার সামনের দিকের চুল সব পড়ে গেছে। আমি তাঁর ঘরে গিয়ে ঢুকতেই তিনি বলবেন, কে, রেনু?
আমি অনেকক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর বললাম, বাবা আমাকে চিনতে পারছেন না?
চিনতে পারব না কেন? কখন এসেছিস?
এই তো কিছুক্ষণ আগে।
বস মা আমার কাছে।
বাবা তার রোগা একটা হাত আমার কোলে তুলে দিলেন।
তুমি আমাকে একটা চিঠিও লেখোনি বাবা।
শরীরটা খারাপ মা। খুব খারাপ।
ঠিক তখন নীলু চা নিয়ে ঢুকল। বাবা মাথা তুলে বললেন, কে, রেনু?
নীলু অত্যন্ত যত্নে বাবাকে বালিশে হেলান দিয়ে বসাল। পিরিচে ঢেলে ঢেলে চা খাওয়াল। নীলু দেখি অনেক কাজ শিখেছে। গিনি গিন্নি ভাব।
সে কোমরে আঁচল জড়িয়ে ছুটোছুটি করে অনেক কাজ করছে। এক ফাঁকে বলল, সংসারের হাল ধরেছি।