ভাল থাকিও ঠিকমত পড়াশুনা করিও।
–তোমার চাচা
নজমুল ইসলাম
নীলু,
তোর চিঠি পেয়েছি আজ বিকেলে।
এখন রাত প্রায় এগারোটা। অনেক রাতে উত্তর লিখতে বসেছি, কারণ আমার রুমমেট কিছু লেখার সময় খুব বিরক্ত করে। ঘাড়ের কাছে মাথা এনে সে চিঠি পড়বে। আমি এতটুকুও পছন্দ করি না, তবু সে এটা করবেই। তার ধারণা আমি কোনো ছেলেকে চিঠি লিখছি। আমার তো আর খেয়ে-দোয়ে কাজ নেই।
বাবার অসুখের খবর পেয়ে খুব খারাপ লেগেছে। এতদিনে সেরেছে নিশ্চয়ই সব জানাবি। নজমুল চাচা লিখেছেন প্রেস বিক্রি হয়ে গেছে। শুনে যা ভয় লাগছে। এখন আমাদের চলবে কি করে? আজ সমস্ত দিন আমার এইসব ভেবে খুব খারাপ লেগেছে। তার ওপর আজ বায়োলজি ল্যাব ছিল। আমাদের ডেমনেসট্রেটর একটা ব্যাঙ এনে ক্লোরফরমন্ড করলেন। আমরা শুধু দূর থেকে দেখলাম। তারপর উনি সেটা কচ করে কেটে ফেললেন। ব্যাঙের হৃৎপিণ্ডটা তখনো লাফাচ্ছে। কি যে খারাপ লেগেছে।
বিকেলে হোস্টেলে ফিরে এসেও বমি বমি লাগছিল। রাতে ভাত খাইনি। আমার রুমমেট তখন ফ্রেঞ্চ টোস্ট করে খাওয়াল। ওর একটা কেরোসিন কুকার আছে। খাটের নিচে লুকিয়ে রাখে। কারণ হলে এই সব এলাউ করে না। কিন্তু বেচারীর খুব রান্নার সখ। কয়েক দিন আগে গাজরের হালুয়া বানোল। এটা বানানো যে এত সহজ তা জানতাম না। খেতেও খুব ভাল হয়েছিল। মেয়েটির নাম মালা। রাজশাহী থেকে এসেছে। অনেক রকম রান্না জানে। দারুণ স্মার্ট মেয়ে। হোস্টেল সুপারের পারমিশন না নিয়েই সে দু’দিন তার এক আত্মীয় বাড়ি থেকে এসেছে!
এখানে নিয়মের খুব কড়াকড়ি। তবে সিনিয়র মেয়েদের বেলায় এতটা নয়। সিনিয়র মেয়েরা দোতলায় থাকে। ওদের সঙ্গে আমাদের তেমন যোগ নেই। ওরা অনেক রকম কাণ্ড-কারখানা করে। গত শুক্রবারে কি হয়েছে জানিস! রাত একটায় হঠাৎ শুনি দারুণ হৈচৈ হচ্ছে। পরে শোনা গেল দোতলার কাটি মেয়ে প্ল্যানচেট করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মা নিয়ে এসেছে। সে আত্মা আবার কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না। হোস্টেল সুপারটুপার এলেন। হুলুস্কুল কাণ্ড।
তুই লিখেছিস তোর রকিব ভাইয়ের সঙ্গে যে দেখা হয়েছিল সে সম্পর্কে কিছু লিখিনি। ইচ্ছে করেই লিখিনি। তুই আবার কি ভাবতে কি ভাববি। যাক এখন লিখছি। সেদিন কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল খাতা কিনতে ন্যুমার্কেটে গিয়েছি। আমার সঙ্গে আছে আমার রুমমেট মালা। সে চুল বাঁধার রাবার ব্যান্ড আর টিপ কিনবে। কেনাকাটা শেষ হবার পর আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি, হঠাৎ মালা বলল-দ্যাখ ঐ ভদ্রলোক তখন থেকে আমাদের পিছে পিছে আসছে আর মিচকি মিচিকি হাসছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। আমাকে তাকাতে দেখেই সে বলল–তুমি নীলু না বিলু?
আমি তখনো চিনতে পারিনি। তখন ভদ্রলোক রাগী গলায় বললেন–চিঠির জবাব দাওনি কেন? তখন চিনলাম। খুব অবাক হয়েছিলাম। এ রকম দাড়িগোঁফ কল্পনাও করিনি। তারপর উনি আমাদের আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। মালা কিছুতেই যাবে না। শেষপর্যন্ত অবশ্যি গেল। তিনি সারাক্ষণই তোর কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। তার কি ধরণা জানিস? তার ধারণা–না বলব না।
শোন নীলু একটা কথা–তুই ঐ ভদ্রলোককে বলবি উনি যেন দাড়িগোঁফ কামিয়ে ফেলেন। যা জঘন্য লাগছিল। ওঁকে।
এই যা–একটা বেজে যাচ্ছে, শুয়ে পড়ি। কাল পরশু আবার চিঠি লিখব।
–বিলু
মা বিলু,
দোয়া নিও। নীলুর নিকট হইতে শুনিলাম তোমাদের দোতলার মেয়েরা প্ল্যানচেটে আত্মা আনিয়াছে। উহাদের সহিত কোনোরূপ সম্পর্ক রাখিবে না। সব কিছু নিয়া ছেলেখেলা ভাল না।
তোমাদের উপরের তলায় নতুন ভাড়াটে আসিয়াছে। অতি সজ্জন ভদ্রলোক। স্বামী-স্ত্রী ও একটি ছেলে। ছেলেটি ঈষৎ দুরন্ত।
তোমার বাবার অসুখ অল্প বাড়িয়াছে। তবে চিন্তার কারণ নাই। শরীরের ওপর অযত্ন ও অবহেলার এই ফল। কিছুদিন ভূগাইবে। আর সব সংবাদ ভালো। জনৈক লোক মারফত আমি মুক্তাগাছার কিছু মণ্ডা পাঠাইলাম। বন্ধু-বান্ধব নিয়া খাইও। আর তোমাদের হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্টের নিকট একটি পৃথক পত্র দিলাম। পত্রটি তাহাকে পৌছাইও এবং আমার সালাম দিও। ইতি।
তোমার চাচা
–নজমুল ইসলাম
হোস্টেল সুপার।
জনাবা,
সবিনয় নিবেদন এই যে, জানিতে পারিলাম। আপনার হোস্টেলের কতিপয় ছাত্রী প্ল্যানচেট না কি যেন করিতেছে। এই সব বিষয় নিয়া ঠাট্টা-তামাশা শুভ নয়। ছাত্রীর অভিভাবক হিসাবে আমি চিন্তাযুক্ত আছি। আপনি যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়া চিন্তামুক্ত করিবেন। আপনার নিকট এই আমার বিনীত প্রার্থনা। ইতি।
–নজমুল ইসলাম
আপা,
তুমি নীলু আপাকে এত লম্বা লিখেছ, আমাকে লেখোনি কেন? আমি খুব রাগ করেছি। আর কোনোদিন তোমাকে চিঠি লিখব না। আল্লাহর কসম।
বাবার অসুখ খুব বেড়েছে। আর আকবরের মার হাতের আঙুলের নিচে ঘা হয়েছে। নজমুল চাচা বলেছেন বেশি পানি ঘাঁটাঘাঁটির জন্যে এটা হয়েছে।
দোতলায় নতুন ভাড়াটে এসেছে করিম সাহেব ভদ্রলোক খুব মোটা। তাঁর ছেলেটি দারুণ দুষ্ট। এবং খুব ফাজিল। সে আমাদের কাচের জগটা ভেঙে ফেলেছে। ভেঙে আবার দাঁত বের করে হাসে। এমন ফাজিল।
–সেতারা
পুনশ্চঃ আপা তোমরা যে রবীন্দ্রনাথের আত্মা এনেছ সে কি করেছে? আমাদের ক্লাসের একটি মেয়ে বলেছে সেও নাকি প্ল্যানচেট করতে পারে। আমার বিশ্বাস হয় না, সে খুব গুল ছাড়ে। এই জন্যে আমরা তার নাম দিয়েছি গুল বাহার।