আমি হেসে বাঁচি না। মিস নীলু আবার কি! কলেজে ওঠার পর দেখি অনেকেই সম্মান-টম্মান করছে। বিশেষ করে আমাদের কলেজের একজন লজিকের স্যার–নাজিবর রহমান ভুইয়া। উনি সব সময় আপনি আপনি করছেন। ছাত্রীরা তার নাম দিয়েছে প্ৰেমকুমার। কারণ তিনি নাকি সব মেয়ের সঙ্গে প্ৰেম করবার চেষ্টা করেন। তাকে প্রতি বছর পাঁচ ছ’বছর হাফসোল খেতে হয়। হাফসোল কী জানিস তো? নাকি তোদের কলেজে এসব কথা বলে না?
যাই হোক নজিবর রহমান স্যার কী করল তোকে বলি। ক্লাসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ নজিবর রহমান স্যারের সঙ্গে দেখা। তিনি ভ্রূ কুচকে বললেন, তুমি ফাস্ট ইয়ারের না?
জি স্যার।
গত ক্লাসে আসিনি কেন?
বাবার জ্বর ছিল তাই আসিনি।
লজিকের কতগুলি ইম্পর্টেন্ট ডেফিনেশন পড়িয়েছি। মিস করলে পরেরগুলি ধরতে পারবে না।
আমি চুপ করে রইলাম। নজিবর রহমান স্যার গভীরভাবে কিছুক্ষণ মাথা দুলিয়ে বললেন, ঠিক আছে আমার কাছে প্রিপেয়ারড নোট আছে। একবার এসে নিয়ে যেও।
আমি অবশ্যি নোট নিতে যাইনি। গেলেই আমার নাম হয়ে যেত প্রেমকুমারী। হিহিহি। উঁচু ক্লাসের মেয়েদের কাছে শুনেছি তার কাছে ক্লাস নোটের দশ-বারোটা কপি তৈরি থাকে। যাদের সঙ্গে তাঁর প্রেম করার ইচ্ছে হয় তাদের তিনি ডেকে ডেকে দেন। ভদ্রলোক কিন্তু পড়ান খুব ভাল। আমাদের আরেকজন স্যার আছে খুব ভাল পড়ান। তাঁর নাম কি জানিস? তাঁর নাম মুরগির গু। কী জন্যে বেচারার এই নাম হল। অনেকদিন ধরে তাঁর এই নাম চলছে। ছোটখাটো মানুষ, খুব পান খান। ক্লাস শুরু করবার আগে ডাস্টার দিয়ে টেবিলে একটা প্রচণ্ড বাড়ি দিয়ে বলেন, নিস্তব্ধতা! ছাত্রীগণ নিস্তব্ধতা হিরন্ময়!। প্রথম দিন তো আমি বহু কষ্টে হাসি সামলালাম, কিন্তু পরে দেখি সাংঘাতিক ভাল পড়ান। তার একটা ভাল নাম হওয়া দরকার ছিল।
ক্লাসের অনেক কথা লিখলাম। আরো মজার মজার ব্যাপার আছে, পরে লিখব। একজন আপা আছেন তার নাম মিস চাটা। দারুণ অসভ্য অসভ্য সব গল্প তাকে নিয়ে। চিঠিতে লেখা যাবে না।
এবার অন্য খবর বলি। মুন্নির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে পিডিবির ইঞ্জিনিয়ার। খুব নাকি বড়লোক। আমি অবশ্যি বিয়েতে যাইনি। কারণ আমাকে যেতে বলেনি। মুন্নি ক্লাসের প্রায় সব মেয়েকে বলেছে, আমাকে বলেনি। রকিব ভাই এসেছিলেন ঢাকা থেকে। আমার অবশ্যি ধারণা ছিল আসবেন। না। বিয়ের পরদিন আমাদের বাড়িতে এলেন। কখন এসেছেন আমি কিছুই জানি না। কি জন্যে যেন বসার ঘরে গিয়েছি, দেখি তিনি বসে বসে বাবার সঙ্গে গল্প করছেন। তাঁর গায়ে নীল রঙের স্ট্রাইপ দেয়া একটা শার্ট ছিল। এমন মানিয়েছিল তাকে কী বলব।
আমার গায়ে ছিল বোম্বে প্রিন্টের ঐ জংলি শাড়িটা। আমাকে নিশ্চয় ভূতের মত লাগছিল। কারণ ঐ দিন আমি চুলও বাঁধিনি, কিছুই করিনি। আকবরের মাকে বলেছিলাম চুল বেঁধে দিতে। সে দিতাছি আপা বলে সেই যে গিয়েছে গিয়েছেই। আর দেখা নেই। আমি গিয়ে দেখি দিব্যি। ঘুমাচ্ছে। তারপর আমিও ঘুমাতে গেলাম। এখন চিন্তা করে দেখ অবস্থা। চুল বাধা নেই। ঘুম ঘুম ফোলা মুখ, পরনে জংলি শাড়ি। কি ভাবলেন উনি কে জানে। আমি তো একদম হতভম্ব হয়ে গেছি। উনি বললেন, তুমি কে নীলু না বিলু?
আর বাবার যা কাণ্ড। বাবা বললেন, সালাম কর নীলু, সালাম কর। সালাম করব কি। আমি বললাম, আপনি বসুন, আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি। উঁহু, আমি বেশিক্ষণ বসতে পারব না। উনি অবশ্যি অনেকক্ষণ বসলেন। চা-টা খেলেন। যাবার আগে আমাকে দুটো বই দিয়ে গেছেন। একটা হচ্ছে–ঘনাদার গল্প (দেখ না কাণ্ড, ঘনাদার গল্প পড়ার বয়স এখন আছে?) অন্যটি হচ্ছে একটি কবিতার বই, নাম–পালক। আজ আর লিখব না, ঘুম পাচ্ছে।
–নীলু
পুনশ্চঃ তোর সঙ্গে যে রকিব ভাইয়ের দেখা হয়েছিল ঢাকায় এই কথাটি তুই কোনো চিঠিতেই লিখিসনি।
প্রিয় আপা,
আমি তোমাকে চারটি চিঠি দিয়েছি, তুমি মাত্র দুটি চিঠির জবাব দিয়েছ। এরকম করলে আমি আড়ি নেব। তখন মজা টের পাবে। বাবার খুব অসুখ। ডাক্তার বলেছেন ম্যালেরিয়া। খুব দুর্বল হয়ে গেছেন। এখন আর বাইরে যান না। আর বাবা তার প্রেসটা বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু কাউকে সেটা বলেননি। নজমুল চাচা এটা শুনে খুব রাগ করেছেন।
আরেকটা খুব খারাপ খবর আছে। আমার গানের স্যারের ছোট ছেলেটা পানিতে ডুবে মরে গেছে। ছেলেটার বয়স সাত। তার নাম দীপন। তুমি তাকে দেখেছিলে। তোমার মনে আছে। তবলা বাজিয়েছিল। তুমি বললে ওমা এইটুকু ছেলে আবার তবলা বাজায়। তোমার কলেজ। কবে
ছুটি হবে?
–সেতারা
প্রিয় মা বিলু,
দোয়া নিও। তোমার বাবার অসুখের সংবাদ পাইয়াছ। এখন কিছুটা সুস্থ, তবে পুরোপুরি সারে নাই। চিন্তার কোনো কারণ নাই। ইতিমধ্যে তোমার লোকাল গার্জেন সফদর সাহেবের একখানি পত্র পাইয়াছি। তুমি নাকি তাকে বলেছি–তুমি ছুটির দিনে হোস্টেলেই থাকতে চাও। এটা ঠিক না। সফদর সাহেব অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। তার কথা শুনিবে। এবং সেই মত চলিবে।
তোমার বাবার ব্যবসা কিঞ্চিৎ মন্দা যাইতেছে। তিনি খুব সম্ভবত প্রেস বিক্রি করিয়া দিয়াছেন। কাজটা ঠিক হয় নাই। চালু প্রেস বিক্রয় করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তুমি কোনরূপ চিন্তা করিও না। তোমাদের অন্য অংশটি ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা করিতেছি। দুই একজনের সঙ্গে কথাবার্তা হইয়াছে। যে কোনো ভাড়াটেকে হুঁট করিয়া ঢুকানো ঠিক হইব না, তাই বিলম্ব হইতেছে।