পরের বার অনেক ভাল হবে দেখবি।
আর দেখতে হবে না।
সবাই কি আর ফাস্ট-সেকেন্ডে হয় নাকি রে বোকা? আমি নিজে তিন বারের বার মেট্রিক পাস করলাম। কিন্তু আইএ-তে আবার ফাস্ট ডিভিশন।
থাক, আপনাকে আর বকবক করতে হবে না।
বাবা নিজে এসেও সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করলেন।
আরো সেকেন্ড ডিভিশন খারাপ নাকি?
খারাপ হবে কেন? খুব ভাল, তুমি যাও তো এখন।
নীলুকে আমরা খুব শক্ত মেয়ে হিসেবে জানতাম। এই ব্যাপারটায় যে সে এতটা মন খারাপ করবে ভাবতেও পারিনি। কিছু দিন পরই সে জুরে পড়ে গেল। অল্পদিনের জুরেই শুকিয়ে-টুকিয়ে অন্য রকম হয়ে গেল। এক রাতে ঘুমুতে এল আমার ঘরে; একা একা তার নাকি ভয় লাগছে। কে যেন বারবার তার জানালার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। আমরা দু’জন অনেকদিন পর একসঙ্গে ঘুমুতে গেলাম। সেতারা শুয়েছে একা একটি খাটে। আমরা দু’জন একটিতে। আমি নরম স্বরে বললাম, এত মন খারাপ করেছিস কেন?
জানি না কেন।
ভুক্তি পড়াশোনাই কািরসন, রেজাল্ট কোথেকে ভাল হবে।
তা ঠিক।
নীলু একটি হাত আমার গায়ের ওপর রেখে বলল, দু’জন এবার আলাদা হয়ে যাব; তুই যাবি ঢাকায় আর আমি এখানে কোনো ভাঙা কলেজে।
আমি ঢাকায় যাব না, এইখানে থাকব।
তুই ঢাকায় পড়তে যাবি একটা তো জনা কথা। সেটাই ভাল। তুই এত ভাল ছাত্রী, তোর তো ভাল কলেজেই যাওয়া উচিত।
আমরা দু’জন হালকা গলায় নানান কথাবার্তা বলতে লাগলাম। অনেক রাতে শুনলাম বাবা ঘরে ফিরেছেন। গুনগুন করে কি বলছেন। রমজান ভাই রাগী গলায় কি-সব বলছেন। নীলু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চল ঘুমিয়ে পড়ি।
প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছি, তখন নীলু বলল, বিলু একটা কথা। জেগে আছিস তো?
আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করতে হবে তোকে।
কী প্রতিজ্ঞা?
নীলু চুপ করে রইল। আমি অবাক হয়ে বললাম, কীসের প্রতিজ্ঞা?
ঢাকায় গিয়ে রকিব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারবি না।
এসব কি বলছিস, আমি দেখা করব কেন?
আর ওর চিঠির জবাব দিবি না।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। নীলু, কাঁদতে শুরু করল। ফোঁপাতে ফোপাতে বলল, কথা দে আমাকে আমার গা ছুঁয়ে বল।
কী যে কাণ্ড তোর!
আমি নীলুকে জড়িয়ে ধরলাম। এমন বোকা কেন নীলুটা?
সেদিন আকাশের রঙ ছিল ঘন নীল।
আমরা এমনিত কখনো আকাশ দেখি না। আমরা আকাশের দিকে তাকাই মন খারাপ হলে। মন বিষন্ন হলে আকাশও বিষন্ন হয়। হেমন্তের এই ঝকঝকে সকালে আকাশটা অসম্ভব বিষন্ন হয়ে গেল। আমি তবু মুখে হাসি টেনে রাখলাম। ভোরবেলা নাশতা খাবার সময় খুব হাসিখুশি থাকতে চেষ্টা করলাম। নজুমলা চাচাও আজ আমাদের সঙ্গে নাশতা খেলেন। নীলু বসে রইল পাথরের মত মুখ করে। বাবা একবার সাবধানে চলাফেরার কথা বললেন।
একা একা কোথাও যাবার দরকার নেই। কোথাও যেতে হলে বন্ধু-বান্ধব কাউকে সঙ্গে নিবি।
নজমুল চাচা বললেন, চিন্তার কিছু নেই, সফদর সাহেব প্রতি শুক্রবারে এসে বাসায় নিয়ে যাবেন। আর ছুটি ছাটা হলো নিজে ময়মনসিংহে এসে পৌঁছে দেবেন। অতি ভদ্র সজ্জন ব্যক্তি।
আমি তাদের কথায় হা-না কিছুই বললাম না। ঠিক যখন যাবার সময় হল তখন ইচ্ছে করল। চেঁচিয়ে বলি–আমি এইখানেই থাকব। এখানকার কলেজে ভর্তি হব। কিছুই বলা হল না।
নজমুল চাচা আমাকে সঙ্গে নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। ট্রেন ছাড়তে খুব দেরি করতে লাগল। বাবা প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে রইলেন ক্লান্ত ভঙ্গিতে। নীলু সেতারা কেউ আসেনি। ওরা খুব কাদছিল। বাবা বলেছিলেন, তোরা আসিস না। তোরা থাক এখানে। আর এত কান্নাকাটির কি আছে। দুই মাস পরে তো আসছেই।
ট্রেন ছেড়ে দেবার সময় বাবা মনে হল খুব অবাক হয়ে পড়েছেন। যেন ভাবতে পারেননি ট্রেন এক সময় ছেড়ে দেবে। তিনি জানোলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার বা হাত শক্ত করে চেপে ধরে ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগলেন। নজমুল চাচা বললেন, আরে কর কি, হাত ছেড়ে দাও। বাবা হাত ছাড়লেন না। যেন শেষমূহুর্তে তার মনে হল আমি চলে যাচ্ছি। তিনি ট্রেনের লোকজন, প্লাটফরমের গাদাগাদি ভিড় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ফুপিয়ে উঠলেন, আমার আম্মি। আমার রাত্ৰিমণি। ওরে বেটি টুনটুন।
আমি পাথরের মত মুখ করে বসে রইলাম। পৃথিবীতে এত কষ্ট কেন থাকে? কেন এত দুঃখ চারদিকে? জানালার ওপাশে কি সুন্দর সব দৃশ্য। গাঢ় নীল রঙের ডোবা একটি। তার ওপর সাদা মেঘের ছায়া পড়েছে। কঞ্চি হাতে একটি ছোট্ট ছেলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ট্রেনের দিকে। পাট বোঝাই একটি গরুর গাড়ির চাকা আটকে গেছে। গরুটি ধবধবে সাদা। এক সময় নজমুল চাচা বললেন, ছিঃ মা কাঁদে না।
চিঠিপত্র
বিলু,
তোর দুটি চিঠিই পেয়েছি। প্রথমটির জবাব সঙ্গে সঙ্গে লিখেছিলাম। রমজান ভাইকে পোস্ট করতে দিয়েছি। ওমা দুই দিন পরে দেখি তার বাজারের ব্যাগ থেকে চিঠি বেরুল। ভিজে ন্যাত। ন্যাতা! অথচ রমজান ভাই আমাকে বলেছে সে নিজ হাতে চিঠি ফেলেছে। দেখ অবস্থা। তারপর তোমার দুনম্বর চিঠিটি এল। ভাবলাম রাতে জবাব লিখব। রাত ছাড়া চিঠি লিখতে ভাল লাগে না। কিন্তু রাতে বাবার খুব জ্বর এল। মাথায় পানি ঢালতে হল, ডাক্তার আনতে হল। ডাক্তার বলছেন ম্যালেরিয়া। দেশে কী এখন ম্যালেরিয়া আছে নাকি যে ম্যালেরিয়া হবে। ডাক্তারটির বয়স খুব কম, আমার মনে হয় নতুন পাস করেছে। আমার মত পাস। বইটই ভালমতো পড়েনি। আমার সঙ্গে গম্ভীর হয়ে কথা বলছিল।
মিস নীলু, ভয়ের কিছু নেই। আমি আবার এসে দেখে যাব।