একদিন দেখি একটি টেলিভিশন কিনে আনলেন। সেতারার খুব সখ ছিল টিভির। কথা ছিল সেতারা আগামী জন্মদিনে ঢাকা থেকে এটি কিনে আনা হবে এবং সেই উপলক্ষে আমরা সবাই দল বেঁধে ঢাকা যাব। তিনি বোধ হয় আমাদের সঙ্গে ভাব করবার জন্যেই আগে-ভাগে কিনে ফেললেন। সন্ধ্যাবেল টিভি চালু হল। আমরা কেউ দেখতে গেলাম না। আকবরের মা এবং রমজান ভাই মোড়া পেতে টিভির সামনে রাত এগারটা পর্যন্ত বসে রইল।
বাবার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেলাম আমরা। সেই সময় বড় মামার চিঠিতে জানলাম মার একটি ছেলে হয়েছে। ছেলের নাম কাজল।
মায়ের শরীর খুব খারাপ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আছেন। কি যে কষ্ট হল আমার। কত লক্ষ বার যে বললাম–মা ভালো হয়ে যাক। মাকে ভাল করে দাও। রোজ রাতে তাকে স্বপ্নে দেখতাম। রক্তশূন্য একটি লম্বাটে ফরসা মুখ। চাদর দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢাকা। স্বপ্ন দেখে রোজ রাতেই কান্দতাম। আমরা তিন বোনই নিশ্চিত ছিলাম মা মারা যাবেন। কিন্তু তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। চিঠি লিখল মা নীলুকে। নীলু তার কোনো চিঠি আমাকে পড়তে দেয় না। কী লেখা ছিল সে চিঠিতে তা জানলাম না। নীলু শুধু বলল, কাজল খুব বিরক্ত করে রাতে মাকে মাতে দেয় না।
এস.এস.সি. পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট
এস.এস.সি. পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট করলাম। এত ভাল যে সেলিনা আপা একদিনের জন্যে স্কুল ছুটি দিলেন। এবং একটি গোন্ড মেডেল দেবার ব্যবস্থা করলেন। খায়রুন্নেসা গোন্ড মেডেল। খায়রুন্নেসা তার মায়ের নাম। এই গোন্ড মেডেলটি সেবারই প্রথম ঘোষণা করা হল। আমাদের স্কুলের কোনো ছাত্রী যদি এস.এস.সি. পরীক্ষায় সমস্ত বোর্ডে প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকতে পারে তবেই সে এই গোন্ড মেডেল পাবে। ময়মনসিংহ ডিস্টিক্ট বোর্ড থেকে আমাকে পাঁচশ টাকা দেয়া হল। শুধু তাই না, একদিন সকালবেলা একজন স্থানীয় সংবাদদাতা আমার ইন্টারভ্যু নিতে এলেন। নজমুল চাচার উৎসাহের সীমা নেই। শাড়ি খুলে একটা কামিজ-টামিজ পর, বয়স কম দেখা যাবে। কানের দুলগুলি খুলে ফেল তো, ভাল ছাত্রীদের এই সব গয়না-টয়না মানায় না। মুখে হালকা করে পাউডার দে।
ইন্টারভ্যু পর্ব সমাধা হতে অনেক সময় লাগল। বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন নজমুল চাচা। যেমন ভদ্রলোক যখন জিজ্ঞেস করলেন, দৈনিক কঘণ্টা পড়াশুনা করতে? আমি কিছু বলার আগেই নজমুল চাচা বললেন, ঘণ্টার কি কোনো হিসাব আছে ভাই? রাতদিনই পড়ছে। যখনই দেখি তখনি মুখের ওপর একটা বই। হা হা হা।
নজমুল চাচা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এই মেয়ের প্রাইভেট টিচার লাগে। কী যে বলেন ভাই।
কথাটি পুরোপুরি মিথ্যা। আজিজ স্যার আমাকে আর নীলুকে সপ্তাহে চারদিন অংক করাতেন। নলিনীবাবু স্যার পড়াতেন ইংরেজি।
পাঠ্য বই ছাড়া বাইরের বই কেমন পড়েছ তুমি?
বাইরের বইতো বেশি পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ টলস্টয় সব আপনার নিচের ক্লাসেই পড়ে শেষ করেছে। হা হা হা।
ইন্টারভ্যু হল আসলে নজুমলা চাচার সঙ্গে। আমি শুধু হাসিমুখে তার পাশে রইলাম। এবং সেই ইন্টারভ্যু খানিকটা ছাপাও হল একটি ইরেজি পত্রিকায়। তার পরপরই একটি চিঠি পেলাম আমরা দু বোন।
কল্যানীয়াষু নীলু অথবা বিলু তোমাদের দুবোনের একজনের ছবি দেখলুম। পত্রিকায়। ছবির সঙ্গে ডাকনাম দেয়া ছিল না। কাজেই বুঝতে পারছি না ছবিটি কার?
যার ছবি তার জন্যে আমার আন্তরিক অভিনন্দন। মফস্বলের একটি স্কুল থেকে এমন চমৎকার রেজাল্ট করা দারুণ ব্যাপার। আমার খুবই ভাল লাগছে। এর মধ্যে একবার ময়মনসিংহ এসেছিলাম। তোমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়েছি। গেট বন্ধ ছিল। কাজেই ভেতরে আর ঢুকিনি। পরে ভেবেছি গেট খুলে ঢুকলেই হত।
অনেক সময় আমরা যা করতে চাই করতে পারি না। কেন পারি না তাও জানি না। পরে তা নিয়ে কষ্ট পাই। ঠিক না?
আমরা কেন যেন মনে হচ্ছে তোমরা দুবোন আমার চিঠি পড়ে খুব হাসবে। অবশ্যি একটি ক্ষীণ আশা যে এই চিঠি তোমাদের হাতে পৌঁছবে না। কারণ তোমাদের ঠিকানা আমার জানা নেই। শুধু জানি তোমাদের দুবোনের একজন হচ্ছে নীলু, একজন বিলু এবং তোমাদের বাড়িটির নাম উত্তর দীঘি। এ রকম সংক্ষিপ্ত ঠিকানায় চিঠি যাওয়ার কথা নয়। ঠিক না?
রকিব হাসান
কত অসংখ্যবার যে সেই চিঠি আমি পড়লাম। প্রতিবারই আমার মনে হয়েছে এই চিঠিতে যা লেখা হয়েছে তার বাইরেও কিছু আছে। আর একবার পড়লেই তা বোঝা যাবে।
চিঠিটি নজমুল চাচাও পড়লেন এবং বললেন, বিশিষ্ট ভদ্রলোক। খুব আদব-কায়দা। একটা ভাল সংবাদ পেয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে চিঠি দিয়েছে। এইসব ভদ্রতা কি দেশে আজকাল আছে। সং শুনলে লোকজন আজকাল বিরক্ত হয়। মা সুন্দর করে গুছিয়ে একটা চিঠি লেখ। বানান ভুল যেন না। থাকে। সাবধান! ডিকশনারি দেখবে। আর শোন, এই চিঠি যত্ন করে তুলে রাখবে। রেজাল্ট নিয়ে যত চিঠি যত টেলিগ্রাম আসবে সব তুলে রাখবে। আলাদা একটা ফাইল করে রাখবে। আমি অফিস থেকে ফাইল নিয়ে আসব।
নীলু চিঠিটার শুরুটা পড়েই গম্ভীর মুখে বলল, তোর চিঠি আমাকে দিচ্ছিস কেন? আমি অন্যের চিঠি পড়ি না।
পড়া যাবে না। এমন কিছু এখানে লেখা নেই।
না থাকুক।
নীলু পাশ ফিরে বালিশে মুখ ঢাকল। তার বেশ কদিন ধরে জ্বর যাচ্ছে। তেমন কিছু নয়, কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠছে না। আমার ধারণা, সে আশা করেছিল তার রেজাল্ট অনেক ভাল হবে। রেজাল্ট মোটেও ভাল হয়নি। ফাস্ট ডিভিশন দেখা শেষ করে আমরা যখন সেকেন্ড ডিভিশন দেখতে শুরু করেছি। সে তখন দৌড়ে পালিয়েছে। নজমুল চাচা তাকে পাসের খবর দিতেই সে কেঁদে-টেদে একটা কাণ্ড করেছে।