কিছু হয়নি।
কাঁদছিস কেন?
তোর কাছে সব কিছু বলতে হবে নাকি?
বললে দোষ কি?
নীলু। কোনো জবাব না দিয়ে গম্ভীর মুখে বাগান ছেড়ে চলে গেল। সকালটা হঠাৎ করেই অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। লোকজন সবাই জেগে উঠেছে। রমজান ভাই ঘটং ঘটং করে টিউবওয়েলের পানি তুলছে। আকবরের মা ময়লা থালা-বাসন এনে জমা করছে টিউবওয়েলের পাশে। এক সময় ঝগড়া লেগে গেল দুজনের মধ্যে। এরা দু’জন দু’জনকে সহ্যই করতে পারে না। তবু কেমন করে থাকে এক সঙ্গে? এদের চেঁচামেচিতেই বোধ হয় বাবার ঘুম ভাঙল। বাবা বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই চারদিক আবার চুপচাপ। বাবা বললেন, আমাকে চা দাও এক কাপ। এরা দুজনে কেউ কোনো উত্তর করল না। আকবরের মা বেড়ালের মতো ফ্যাসফ্যাস করে কি বলতেই আবার বেঁধে গোল রমজান ভাইয়ের সঙ্গে। বাবা দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ। আজকাল কেউ আর বাবাকে তেমন গ্রাহ্য করে না। আমি এগিয়ে এসে বললাম, আমি বানিয়ে আনছি। বাবা।
তুই আবার চা বানাতেও জানিস নাকি?
জানিব না কেন?
বাবা অবাক হয়ে বললেন, কার কাছে শিখলি?
কী আশ্চর্য কাণ্ড, চা বানানো আবার শিখতে হয় নাকি? বাবা এরকম ভান করতে লাগলেন
যেন খুব অবাক হয়েছেন।
আর কি জানিস, রান্নাবান্না করতে পারিস? ভাত-মাছ এইসব?
নাহ।
এইগুলিও শিখে ফেল। একদিন বিয়েটিয়ে হবে। রান্নাবান্না না জানলে বিয়ে দেয়াই যাবে না, হা হা হা।
অনেক দিন পর বাবা হাসলেন। মানুষের হাসির মতো সুন্দর কি কিছু আছে? বাবার হাসির সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে রোদ ঝলমল করে উঠল।
মা একটা কথা সব সময় বলতেন, মানুষ যখন হাসে তখন তার সঙ্গে সমস্ত পৃথিবী হাসে। কিন্তু সে যখন কাঁদে, তার সঙ্গে আর কেউ কাঁদে না। কাঁদতে হয় একা একা।
চা বানাতে বানাতেই শুনলাম সেতারা গলা সাধা শুরু করেছে। নিসা গামা পামা গামা। গামা পামা গারে সা। গান-টান কিছু না, সামান্য সারে গামা, কিন্তু কি যে ভাল লাগছে শুনতে।
বাবাকে চা নিয়ে দিতেই বাবা বললেন, ভাবছি তোদের নিয়ে কোথাও ঘুরেটুরে আসব। যাবি নাকি?
কোথায়?
গারো পাহাড়ে গেলে কেমন হয়? জাড়িয়া জঞ্জাইল লাইনে বেশি দূর হবে না। ছয়-সাত ঘণ্টা লাগবে ট্রেনে। বন বিভাগের একটা রেস্ট হাউস আছে। যাবি নাকি?
যাব বাবা।
জায়গাটা সুন্দর। রাতের বেলা একটু ভয় ভয় লাগে।
কেন?
বন্য হাতির শব্দটব্দ পাওয়া যায়। এখন বোধ হয়। আর সে রকম নেই। তোরা যদি যেতে চাস তাহলে একটা প্রোগ্রাম করি।
যাবে কবে?
দুই দিনের মাত্র ব্যাপার, একটা তারিখ করলেই হয়। তুই নীলুকে জিজ্ঞেস করে আয় ও যাবে কি-না।
নীলু সব শুনে লাফিয়ে উঠল। বেড়ানোর ব্যাপারে নীলুর মতো উৎসাহী আর কেউ নেই। গারো পাহাড় দেখতে যাওয়া হবে শুনেই তার সব রাগ পড়ে গেল। নানান রকম পরিকল্পনা করে ফেললাম আমরা। যেমন শম্পাদের ক্যামেরাটা নিয়ে যাব এবং খুব ছবি তুলব। সেখানে আমরা দুজনেই শাড়ি পরব। এবং এই উপলক্ষে বাবাকে বলব দুটি শাড়ি কিনে দিতে। বন বিভাগের রেস্ট হাউসে রাতের খাবার-টাবার হয়ে যাবার পর বাবাকে বলব। গল্প বলার জন্যে। বাবা অবশ্যি গল্পটল্প তেমন বলতে পারে না। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা হারিকেন জ্বলিয়ে বসে। থাকব। হারিকেনের আলো কী যে ভাল লাগে আমার।
একেকটা দিন এমন অন্যরকম হয়। মনে হয় দুঃখ-টুঃখ সব বানানো ব্যাপার। চারদিকে শুধু সুখ এবং সুখ। সন্ধ্যাবেলা আমরা দুবোন শাড়ি পরে বারান্দায় হাঁটছি, নজমুল চাচা ডেকে পাঠালেন।
কিরে বেটিরা শুনলাম দল বেঁধে নাকি পাহাড়ে যাচ্ছিস?
জি চাচা।
তা আমাকে একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করিল না? আমারও তো পাহাড়-টাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করে।
সত্যি সত্যি যাবেন আমাদের সাথে?
এরকম পরীর মতো মেয়েদের পাহারা দিয়ে রাখার জন্যেও তো লোকজন দরকার।
পরের কয়েকটি দিন আমাদের দারুণ উত্তেজনার মধ্যে কাটল। একদিন শুনলাম বন বিভাগের ডাকবাংলোটা পাওয়া গেছে। তারপর দিন-ক্ষণ ঠিক হল। নতারিখে ভোরের ট্রেনে যাব, পৌঁছব বিকাল নাগাদ। নজমুল চাচা যাবেন। রমজান যাবে। বাবার প্রেসের একজন কম্পোজিটর মাখন মিয়া সেও যাবে। কারণ মাখন মিয়ার বাড়ি ঐ অঞ্চলে, সে সব খুব ভাল চেনে।
আট তারিখ রাতে বাবা বাড়ি ফিরলেন না। রাত একটায় নজমুল চাচা খোঁজ নিতে গেলেন। আমরা তিন বোন বসার ঘরে বসে রইলাম চুপচাপ। নজমুল চাচা ফিরলেন দুটার দিকে এবং হালকা গলায় বললেন, কাজে আটকা পড়ে গেছে, সকাল বেলাতেই চলে আসবে। ঘুমিয়ে পড়! নীলু, শান্ত স্বরে বলল, বাবার কি হয়েছে বলেন?
কি আবার হবে। কাজ থেকে না মানুষের?
নজমুল চাচা রেগে গেলেন। নীলুও রেগে গেল।
বাবার কি হয়েছে বলেন।
কাল সকালে আসবে, তখন জিজ্ঞেস করিস। কিছু হয়নি, ভালই আছে।
নীলু তেজী গলায় বলল, আপনাকে এখন বলতে হবে।
এরকম করে তুই আমার সঙ্গে কথা বলছিস কেন?
নীলু কেঁদে ফেলল। বাবা ফিরলেন। পরদিন দুপুরে। কোর্ট থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে। তার রাত কেটেছিল থানা হাজতে। মদ খেয়ে খুব নাকি হৈচৈ করছিলেন বা এই জাতীয় কিছু। খুবই কেলেংকারি ব্যাপার। আমরা সপ্তাহখানেক কেউ স্কুলে গেলাম না। ঠিক করলাম বাবার সঙ্গে কেউ কোনো কথা বলব না। ডাকলেও সাড়া দেব না। এমন ভাব করব যেন শুনতে পাইনি। কোনো লাভ অবশ্যি তাতে হল না। বাবা আমাদের ডাকাডাকি বন্ধ করে দিলেন। যতক্ষণ বাসায় থাকেন। চুপ করে থাকেন।