পারি। নীলুটা খুব হাত নেড়ে কথা বলে।
রকিব সাহেব দোতলায় বসে আছেন শুনে নীলু দারুণ অবাক হল। সে কি, আমি তো বলেছি এ বাড়িতে যেন কখনো না আসেন।
কি জন্যে বলেছিস?
দূর ভাল্লাগে না।
ভাল্লাগে না কেন?
এমনভাবে কথা বলে যেন আমি বাচ্চা মেয়ে।
যাবি না তাহলে?
উঁহু।
নীলু যদিও বলল উঁহু, কিন্তু আমি দেখলাম সে কামিজ বদলে শাড়ি পরছে।
শাড়ি পরছিস কেন?
ইচ্ছা হয়েছে পরছি। তোকে জিজ্ঞেস করে কাপড় পরতে হবে?
নীলু অনেক সময় নিয়ে মুখে পাউডার দিল। এবং এক সময় চিরুনী হাতে এসে বলল, চুল বেঁধে দিবি?
আমি চুল বেঁধে দিয়ে বললাম, আজ আর তোকে কেউ বাচ্চা মেয়ে বলবে না।
নীলু রাগী স্বরে বলল, তুই কি ভাবছিস আমি তোতলায় যাচ্ছি? মোটেই না, আমি বাগানে হাঁটতে যাচ্ছি। সেতারার গলা সাধা শেষ হলেই যাব।
আমি দেখলাম নীলু। সত্যি সত্যি সেতারাকে নিয়ে বাগানে বেড়াচ্ছে। অপূর্ব লাগছে তাকে। আমার মনে হল এমন রূপবতী মেয়ে আমি আর কখনো দেখেনি।
বড় মামার চিঠি এসেছে।
সুদীর্ঘ চিঠি। যার বক্তব্য হচ্ছে–এ সময় গ্রামের বাড়িতে নীলু-বিলুদের বেড়াতে আসা ঠিক হবে না। কি কারণে ঠিক হবে না তা স্পষ্ট করে বলা নেই। শুধু লেখা–গাঁয়ের লোকজন এদের
দেখতে এসে নানান কথা বলবে, এটা ওদের ভাল লাগবে না। মনের ওপর চাপ পড়বে। এইসব। আমার কাছে একটা ব্যাপার খুব অবাক লাগল। চিঠির শেষে পুনশ্চতে লেখা–যা হবার হইয়াছে, এখন দুলাভাই আপনি যদি হৃদয়ের মহত্ত্ব দেখাইয়া সব ভুলিয়া যান তাহা হইলে বড়ই আনন্দের বিষয় হয়। ভুল মানুষ মাত্রই করে। ইহাই মানব ধর্ম।
এর মানে কি? নতুন করে এইসব কথা তোলা হচ্ছে কেন?
নীলুকে জিজ্ঞেস করতেই সে হেসে বলল, বুঝতে পারছিস না? মা এখন মামার বাড়িতে।
তার মানে?
মানেটানে জানি না। মা এখন মামার ঘাড়ে চেপে বসে আছে। মামা ঘাড় থেকে নামাতে চাইছে।
বুঝলি কি করে?
এখানে না বোঝারী কিছু আছে নাকি?
নীলু। তরল গলায় হাসল।
শেষ পর্যন্ত দেখবি বাবা বলবেন, ঠিক আছে চলে আসুক। আর মা তার ছেলে কোলে নিয়ে এ বাড়িতে উঠে আসবেন। খুব কান্নাকাটি হবে কিছুদিন। তারপর সব ঠিকঠাক। মাঝখান থেকে আমরা একটা ভাই পেয়ে যাব।
তোর কথার কোনো ঠিকাঠিকানা নেই নীলু।
না থাকলে কি আর করা। তবে এ রকম হলে মন্দ হয় না। কি বলিস? বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাচেছ। যাচ্ছে না?
হুঁ।
বাবা যে হারে মদ-টদ খাচ্ছে। একেবারে দেবদাসের মতো–
নীলু। হেসে উঠল।
এর মধ্যে হাসির কি আছে?
কান্নারও কিছু নেই।
নীলু গম্ভীর মুখে বই নিয়ে পড়তে বসল। ইদানীং তার পড়াশোনায় খুব মনোযোগ হয়েছে। এই নিয়ে কিছু বললে সে গম্ভীর হয়ে বলে, তোরা সব স্টার-ফার পেয়ে পাস করবি আর আমি বুঝি ফেল করব? সেটা হচ্ছে না।
এখন আমাদের স্কুলটুল নেই। পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে জোরেসোরে। সপ্তাহে তিনদিন কোচিং ক্লাস হয়। সেখানে মেয়েরা সবাই ভান করে যে কিছু পড়াশোনা হচ্ছে না। কে কোন কলেজে পড়বে। সে নিয়েও ক্ষীণ আলোচনা হয়। হলিক্রস কলেজ ভাল না। ইডেন ভাল সব মেয়েরাই সেটা জানে।
এমন সিরিয়াস পড়াশোনার সময়টাতেও আমাদের ক্লাসের রুবিনার বিয়ে হয়ে গেল। সেলিনা আপা খুব রাগ করলেন–বাবা-মাদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই নাকি? সেলিনা আপা খুব কাটা কাটা কথা বলে অপমান করলেন রুবিনার বাবাকে। ঝাঁঝাল গলায় বললেন, আপনাদের মত শিক্ষিত মূর্থের জন্যে দেশের এমন খারাপ অবস্থা।
রুবিনা খুবই কান্নাকাটি করতে লাগল। গায়ে হলুদের দিন দেখি কেঁদে মুখটুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। রুবিনার এক মোটাসোটা খালা পানিভর্তি মুখ নিয়ে বলে বেড়াচ্ছেন, মেট্রিক ক্লাসটা হচ্ছে মেয়েদের বিয়ের বয়স। এরপর আর রসকষ থাকে না। নীলুটা ফস করে বলে বসল, কেন, তখন রস কি হয়?
রুবিনার খালা চোখ বড় বড় করে বললেন, এই ফাজিল মেয়েটা কে?
নীলু হাসিমুখে বলল, ফাজিল বলছেন কেন?
খুব হাসোহাসি শুরু হয়ে গেল চারদিকে। রুবিনার খালা রেগেমেগে অস্থির। কয়েকবার বললেন, আজিকালিকার মেয়েগুলি এমন কেন?
অনেকদিন পর রুবিনার গায়ে হলুদ উপলক্ষে আমরা খুব হৈচৈ করলাম। বিয়েটিয়ে এই জাতীয় অনুষ্ঠান আমার ভাল লাগে না। গাদাগাদি ভিড়। মেয়েদের লোক দেখান আহাদীপনা। খাবার টেবিলে তাড়াহুড়ো করে বসতে গিয়ে শাড়িতে রেজালার ঝোল ফেলে দেয়া। অসহ্য! কিন্তু রুবিনার গায়ে হলুদ আমার কেন যে এত ভাল লাগল। বরের বাড়ি থেকে এলা নামের একটি মেয়ে এসেছিল, সে ঢাকায় ও লেভেলে পড়ে। ওর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। জন্মের বন্ধুত্ব। এর আগে আর কোনো মেয়ের সঙ্গে এত বন্ধুত্ব হয়নি। আমরা দু’জন এক ফাঁকে ছাদে চলে গেলাম। মেয়েটি নানান কথা বলতে লাগল। একটি ছেলের সঙ্গে তার ভাব হয়েছে। ছেলেটি মেডিক্যালে পড়ে। এক বিয়ে বাড়িতে আলাপ হয়েছিল। খুব নাকি লাজুক ছেলে। আর দারুণ ভদ্র। এলা নিচু স্বরে বলল, জানো ভাই, ও একবার যা অসভ্য কথা লিখেছিল আমাকে। আমি খুব রাগ করলাম। ওর সঙ্গে দেখা করাই বন্ধ করে দিলাম। টেলিফোন করলে টেলিফোন নামিয়ে রাখতাম। শেষে কি করল সে জান?
কি করল?
বলল সে বিষ খাবে। আমি তো জানি তাকে। খাবে বলেছে। যখন তখন খাবেই। ছেলেরা দারুণ সেন্টিমেন্টাল হয় ভাই।
তখন তুমি কি করলে?
কি আর করব, দেখা করলাম।
আমি ইতস্তত করে বললাম, অসভ্য কথাটা কি লিখেছিল?
এলা তরল গলায় হেসে উঠল, দূর তা বলা যায় নাকি? বিয়ের দিন তুমি আসবে তো? ঐ দিন তোমাকে ওর ঐ চিঠিটাই পড়াব। দেখবে ছেলেরা কি রকম অসভ্য হয়।
রুবিনার বিয়ের দিন
রুবিনার বিয়ের দিন আমরা কেউ ও-বাড়িতে গেলাম না। নীলুর জন্যেই যাওয়া হল না। সে কিছুতেই যাবে না এবং আমাকেও যেতে দেবে না।