না বাবা, আমরা নীলু আপাকে ভয় দেখাবার জন্যে এসেছি।
বাবা হেসে উঠেলেন। দীর্ঘদিন পর বাবা এমন উঁচু গলায় হাসলেন।
নীলু, চোখ মুছে বলল, আমাকে ভয় দেখানো এত সস্তা না!
আমাদের বাড়িটির একটি নাম আছে ‘উত্তর দীঘি’। বাড়ির কত সুন্দর সুন্দর নাম থাকে। কিন্তু এ বাড়িটি দেখতে যেমন অদ্ভুত, নামটিও তেমনি। মায়ের খুব সখ ছিল শ্বেত পাথরের একটা নতুন নেম প্লেট লাগাবেন, মাধবী ভিলা লেখা থাকবে সেখানে।
বাড়িটি কিনেছিলেন আমার দাদা। তিনি ধুরন্ধর প্রকৃতির লোক ছিলেন। দাঙ্গার সময় যখন ময়মনসিংহ শহরের বেশির ভাগ ধনী হিন্দু জলের দামে বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় চলে গেল, আমার দাদা। তখন উত্তর দীঘি ও শ্ৰীকালী প্রেস কিনে ফেললেন। টাকা যা দেয়ার কথা তার অর্ধেকও নাকি দেননি। এই সব আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা। মা নাকি বিয়ের পর অনেকদিন দেখছেন বাড়ির মালিক বাকি টাকার জন্যে এসে বসে আছে এবং দাদা নানান রকম টালবাহানা করছেন। তার কিছু দিন পর দাদা মারা যান। আমার ধারণা লোকটিকে টাকা-পয়সা না দেয়ার জন্যেই নিদারুণ যন্ত্রণায় দাদার মৃত্যু হয়েছে। তাঁর পেটে ক্যান্সার হয়েছিল।
আমাদের উত্তর দীঘি বাড়িটি প্রকাণ্ড। দোতলা বাড়ি। তবে ছাদে ওঠার কোনো সিঁড়ি নেই। মার খুব সখ ছিল ছাদে ওঠার সিঁড়ি করবেন। জোছনা রাতে ছাদে হাঁটাহাঁটি করা যাবে। হাঁটাহাটি করার জায়গার অভাব এ বাড়িতে নেই। অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাড়ি। কাঁঠাল পেয়ারা আম এবং তেঁতুল গাছ দিয়ে বাড়িটা ঘেরা। বাড়ির সামনে ফুলের গাছ আছে বেশ কয়েকটা এবং জায়গায় জায়গায় সিমেন্ট দিয়ে উঁচু বেদীর মত করে বাধানো। সেখানে বসে খুব আরাম করে গল্পের বই পড়া যায়। আমার যখন কিছু ভাল লাগে না তখন আমি লাল বেদীগুলোর কোনো-একটিতে বসে থাকি। নীলুর মতে ওগুলো আমার গোসাঘর।
আজ আমার মন খুব ভাল ছিল। মন ভাল হওয়ার কোনো কারণ ঘটেনি। কিন্তু ভালো লাগছিল। তবু আমি গোসাঘরে এসে চুপচাপ বসে রইলাম। সেতারা দোতলার বারান্দায় বসে গলা সাধছিল। বেশ লাগছিল শুনতে। এমন সময় একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। নীলুর সেই রকিব ভাই হঠাৎ করেই যেন আমার সামনে এসে উপস্থিত হলেন। এখানে আসতে হলে গেট খুলে অনেকখানি হাঁটতে হয়। কখন গেট খুললেন এবং কখনই-বা এলেন।
ভাল আছ?
আপনি ভাল আছেন?
আমি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিলাম, তুমি পাথরের মূর্তির মত বসে আছ। তোমার বাবা বাসায় আছেন?
জি না। সন্ধ্যা নাগাদ আসবেন।
আমি তার সঙ্গে দেখা করব আজকে, কী বল?
ঠিক আছে।
আমি পরশুদিন সকালে ঢাকা চলে যাব। ভাবলাম যাবার আগে দেখা করে যাই। আর আসা হবে কিনা জানি না।
আর আসবেন না বুঝি?
ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে বললেন, তুমি কী আসতে বল?
আমি চুপ করে রইলাম।
কি, কথা বলছি না যে?
আমি কিন্তু বিলু, আপনি আমাকে নীলু ভাবছিলেন।
ভদ্রলোক চশমা খুলে কাঁচ পরিষ্কার করতে লাগলেন।
নীলু কি বাসায় আছে?
জি আছে। আপনি ভেতরে এসে বসুন, আমি ডেকে দিচ্ছি।
না ঠিক আছে ডাকতে হবে না।
ডাকতে হবে না কেন? আপনি তো ওর সঙ্গেই কথা বলতে এসেছেন?
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন।
ঠিক তা না। আমি নদীর ধার দিয়ে অনেকখানি হাঁটি। আজও তাই করছিলাম। হঠাৎ তোমাকে দেখলাম। ভাবলাম নীলু।
ও।
নীলু অনেকদিন মুন্নিদের বাড়িতে যায় না। মনে হয় ওর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। তুমি জানো কিছু?
জি না। ওর সঙ্গে আমার কথা বন্ধ।
ভদ্রলোক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তোমরা যে বাচ্চা মেয়ে এটাও মনে থাকে না।
আমি বুঝি বাচ্চা মেয়ে?
হুঁ! তোমরা আড়ি দাও এবং ভাব দাও। ঠিক না?
আমি দেই না, নীলু দিতে পারে। আসুন, ভেতরে এসে বসুন। নজমুল চাচা আছেন, দোতলায় তার ঘরে ও বসতে পারেন।
নজমুল চাচা কে?
আমাদের একজন ভাড়াটে দোতলায় একটা ঘর নিয়ে থাকেন।
নীলু শোন, আমি এখন আর ঘরে ঢুকব না।
আমি কিন্তু বিলু।
ও হ্যাঁ বিলু। তুমি এক কাজ কর, আমি নীলুব জন্যে একটা গল্পের বই এনেছিলাম, ‘ঘনাদার গল্প’ ওটা ওকে দিয়ে দিও।
আমি অল্প হাসলাম। ভদ্রলোক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন, হাসছ কেন?
আপনি একটু আগে বলেছিলেন নীলুর সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আসেননি, এখন বলছেন বই নিয়ে এসেছেন তাই হাসছি।
ঠিক তখন দোতলার বারান্দা থেকে নজমুল চাচা ডাকলেন, এই–এই বিলু উনি কে?
নজমুল চাচার গলা ভয় ধরানো, যেন হঠাৎ ভূত দেখেছেন। অনেকক্ষণ থেকেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন হয়ত।
পরিচয় করিয়ে দেবার পর নজমুল চাচা অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
আরে আপনি জমির আহমেদ সাহেবের ছেলে? আপনাকে চিনিব না বলেন কি? আপনার বাবা ছিলেন কালিনারায়ণ স্কলার।
আমি বাবার মত হইনি অবশ্যি।
আরে আপনিই কম কি। অংকের প্রফেসর! কি সর্বনাশ।
প্রফেসর না। লেকচারার
আমার কাছে লেকচারারও যা প্রেফেসরও তা। কী আশ্চৰ্য কাণ্ড বলেন দেখি! নীলুর সঙ্গে আলাপ হল কিভাবে?
ও আমাকে একটা অংক জিজ্ঞেস করেছিল, আমি করতে পারিনি।
বলেন কি! কী অংক?
ও জিজ্ঞেস করল–পাঁচের সঙ্গে দুই যোগ করলে কখন ছয় হয়?
কখন হয়?
যখন ভুল হয় তখন হয়। অংকটা আসলে সহজ।
নজমুল চাচা ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন। আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, যা নীলুকে আসতে বল। বলবি প্রফেসর সাহেব এসেছেন। চা-টার ব্যবস্থা করতে হবে।
আমি ঘর থেকে বেরোবার সময় শুনলাম ভদ্রলোক বলছেন, আপনি কি বুঝতে পারেন কে বিলু কে নীলু?