চিকিৎসা করছেন?
নিজের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে করছেন। আমি যে কবার তার কাছে গিয়েছি তিনি জোর করে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছেন।
কী ওষুধ?
ইপিকাক। আপনি যদি কিছুক্ষণ তাঁর সামনে থাকেন তাহলে আপনাকেও হয়তো কোনো ওষুধ খাইয়ে দেবেন।
তুমি যে সব দুঃস্বপ্ন দেখ তার মধ্যে তোমার শ্বশুরকে কখনো দেখেছ?
মনে নেই চাচা।
মা শোন, মাথার কাছে সব সময় একটা খাতা রাখবে। আর কলম রাখবে। খাতাটা হলো স্বপ্ন-খাতা। স্বপ্ন দেখে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়। সঙ্গে সঙ্গে খুব গুছিয়ে স্বপ্নটা লিখে ফেলবে। অবশ্যই তারিখ দেখে। সময় লিখে রাখবে। আপাতত ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি–ডরমিকাম। সাইড এফেক্ট নেই বললেই হয়। বিছানায় যাবার আধঘণ্টা আগে একটা ডরমিকাম খাবে।
চাচা আমারতো ঘুমের কোনো সমস্যা নেই, বিছানায় যাওয়া মাত্র আমার ঘুম পায়। ঘুমের ওষুধ খাব কেন?
ঘুমের ওষুধটা খাবে যাতে সাউন্ড শ্ৰীপ হয়। ঘুম গাঢ় হলে দুঃস্বপ্ন দেখবে না।
দুঃস্বপ্ন না দেখলে স্বপ্নের খাতায় দুঃস্বপ্নগুলো লিখব কীভাবে? আমার সমস্যাটা কী তা বুঝার জন্যেই তো স্বপ্নগুলোর বিষয়ে আপনার জানা দরকার।
নবনীর কথায় প্রফেসার এ. কে. হোসাইন এমনভাবে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকালেন যে নবনীর হাসি পেয়ে গেল। সে হাসি চাপা দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, চাচা। আপনি ভুরু টুরু কুঁচকে ফেলেছেন কেন? আপনি কি আমার কথায় বিরক্ত হয়েছেন?
সামান্য হয়েছি। কেউ যখন তুচ্ছ কথা নিয়ে পেঁচায়–আমার ভালো লাগে না। তোমার মধ্যে এই অভ্যাসটা আছে।
নবনী আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল, চাচা আপনার মেজাজ খিটখিটোতো, এই জন্যেই আমার কথা পেঁচানো মনে হচ্ছে। আমি মোটেও পেঁচানো কথা বলছি না। আপনার নাক্সভূমিকা খাওয়া উচিত। খিটখিটে মেজাজের মানুষদের প্রধান ওষুধ হলো নাক্সভূমিকা। দুইশ পাওয়ারের নাক্সভূমিকা সকালে চারটা আর রাতে চারটা করে খাবেন। এই ওষুধ আমি শিখেছি আমার শ্বশুরের কাছ থেকে। আপনি বললে আমি আমার শ্বশুরের কাছ থেকে ওষুধ এনে দেব।
ভদ্রলোক কিছু বললেন না। স্থির চোখে নবনীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সেদিন তাঁর দৃষ্টি দেখে নবনীর মনে হয়েছিল নবনীর মতো রোগী তিনি খুব বেশি দেখেন নি। দেখার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহও নেই।
ভারী গম্ভীর গলায় কে যেন ডাকল, নবনী!
নবনী ভ্রূ কুচকাল। গলাটা কার চিনতে পারল না। এ বাড়িতে এ রকম গম্ভীর গলাতো কারো নাই। তারপর মনে হলো এটা তার বাবার গলা। খুব চেনা মানুষকে মাঝে মাঝে যেমন অচেনা মনে হয়, দীর্ঘদিনের পরিচিত গলাও হঠাৎ হঠাৎ খুবই অপরিচিত লাগে। বিস্মিত হয়ে ভাবতে হয় কে কথা বলছে?
নবনীর বাবা ফরহাদ সাহেব সকাল ন’টার মধ্যে বের হয়ে যান। তার কোনো ছুটি ছাটা নেই। সপ্তাহের যে দু’দিন অফিস বন্ধ সে দুদিন তিনি যান কারখানায়। তাঁর দু’টা সুতার কারখানা আছে। গাজীপুরে জাপানি কোলাবরেশনে চিনামাটির কারখানা দিচ্ছেন। প্ৰডাক্টের নাম হবে ‘নবনী’। আজ বের হন নি তার মানে কোনো সমস্যা আছে। নবনীর সমস্যা ভালো লাগে না। নিজের সমস্যা তো ভালো লাগেই না। আশেপাশের মানুষদের সমস্যাও ভালো লাগে না। সে চায়ের কাপ হাতে শোবার ঘর থেকে বের হলো। এই কাজটা করতেও তার ভালো লাগছে না। দিনের প্রথম চা সে আরাম করে নিজের ঘরে বসে খেতে ভালোবাসে। দিনের প্রথম অংশ এবং দিন শেষের অংশটি তার নিজের। বাকি অংশগুলো অন্যরা ভাগাভাগি করে নিক।
ফরহাদ সাহেব মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। তার খালি গা, পরনে লুঙ্গি। গৌর বর্ণের মানুষ। মাথা ভর্তি ধবধবে সাদা চুল। তিনি অত্যন্ত মিষ্টভাষি, কারো সঙ্গেই উঁচুগলায় কথা বলেন না; তারপরেও তাকে মনে হয় দূরের মানুষ। কাছের কেউ না। ফরহাদ সাহেবের সামনে খবরের কাগজ বিছানো। নবনীকে দেখে তিনি হাসি মুখে বললেন, তোর বয়েসী একটা মেয়ে সকাল দশটা পর্যন্ত কী করে ঘুমায় আমিতো ভেবেই পাই না।
নবনী গম্ভীর গলায় বলল, তুমি যেমন আমার ব্যাপারটা ভেবে পাও না, আমিও ভেবে পাই না তুমি কী করে দিনের পর দিন ভোর পাঁচটায় উঠ। তোমার বয়েসী মানুষদের মধ্যে আলস্য থাকবে। ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেলেও কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করবে। ঘুম ভাঙা মাত্র লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামবে না।
ফরহাদ সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, অভ্যাস করলেই হয়। চার পাঁচ দিন চেষ্টা করলেই দেখবি ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙ্গার অভ্যাস হয়ে যাবে।
এরকম বিশ্ৰী অভ্যাস করার দরকার কী?
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙ্গা বিশ্ৰী অভ্যাস?
অবশ্যই বিশ্ৰী অভ্যাস। শরীরকে আরাম দিতে হয়। বাবা। শরীরকে কষ্ট দেবার মানে কী? শরীরকে কষ্ট দেবার মানে হলো, শরীরের ভেতর যে আত্মা বাস করে তাকে কষ্ট দেয়া।
ফরহাদ সাহেব হাসি মুখে বললেন, ভুল লজিকে তোর মাথাটা ভর্তি। তোর যেটা করা উচিত সেটা হচ্ছে একটা চিমটা দিয়ে তোর মাথা থেকে এক এক করে ভুল লজিক বের করে ফেলা।
নবনী বাবার পাশে বসতে বসতে বলল, তুমি আজ অফিসে যাবে না?
ফরহাদ সাহেব বললেন, না।
যাবে না কেন? শরীর খারাপ?
শরীর ঠিকই আছে। যে মানুষ ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে তার শরীর এত সহজে খারাপ হয় না। তুই কি মুখ না ধুয়েই চা খাচ্ছিস?
হুঁ।
তোকে দেখেইতো মা আমার কেমন ঘেন্না ঘেন্না লাগছে।
কিছু করার নেই বাবা, আমি এ রকমই।
ফরহাদ সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, তোর এমন অদ্ভুত আচার আচরণ দেখে শ্বশুরবাড়ির লোকজন কিছু বলে না?