ডাক্তার বসল। চেয়ারম্যান সাহেব সামান্য বুকে এসে বললেন–হেনার বিষয়ে আরো কিছু কথা আছে। তোমারে পরে বলব।
জ্বি আচ্ছা।
আমার কথাবার্তা কি তোমার কাছে আউল লাগতেছে?
জ্বি না।
ঝড়ের সময় এমন ভয় পাইছি–আধা বোতল খেয়ে ফেলেছি। কাজেই কথা বার্তা আউলা। কিছু মনে নিবা না। আমি যে লোক খারাপ এই খবর কি তুমি পেয়েছ?
ডাক্তার চুপ করে রইল। নেশাগ্ৰস্ত মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলা সহজ। প্রশ্ন করলে জবাব দিলেও চলে, জবাব না দিলেও চলে। নেশাগ্ৰস্ত মানুষ নিজের কথাই শুনে। অন্যে কী বলছে, না বলছে তা তার মাথায় ঢোকে না।
আমি লোক খুবই খারাপ বুঝছ ডাক্তার। অত্যধিক খারাপ। এমন সুন্দরী এক মেয়ে নিজের কাছে এনে রেখেছি কেন? মেয়ের উপকারের জন্যে? এইটা ভাববা না। যা বলার বলেছি–এরচে’ খোলাসা করে বলতে পারব না। তবে আমার মনে স্নেহ মমতা আছে। এই মেয়েরে আমি নিজ খরচায় বিবাহ দিব। গলা-কান-হাতের গয়না দিব।
ডাক্তার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। মাতাল মানুষ কথা বলতেই থাকবে। শেষ পর্যন্ত আলাপ কোন দিকে যাবে কে জানে। ইমাম সাহেব সম্পর্কে যে কথাগুলো বলা হয়েছে তা মনে হয় মাতাল হবার কারণে বলা। কিছু কিছু মানুষকে দেখলেই মনে হয়–মানুষটা ভালো। ইমাম সাহেব সে রকম একজন। সরল মুখ, সরল কথাবার্তা। একবার আনিস রোগী দেখে ফিরছিল, ইমাম সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। ইমাম সাহেব বিনয়ের সঙ্গে সালাম করে বললেন, ডাক্তার সাহেবের মনটা মনে হয়। খারাপ। কী হয়েছে জনাব?
আনিস বলল, একজন রোগী দেখে এসেছি। রোগীর অবস্থা ভালো না। তাকে শহরে নিয়ে যেতে পারলে বাচানোর সম্ভাবনা ছিল। এখন সম্ভাবনা নাই বললেই হয়। মনটা এই কারণেই খারাপ।
ইমাম সাহেব বললেন, রোগীর নাম কী?
আনিস বলল, নাম দিয়ে কী করবেন?
তার জন্যে খাস দিলে আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া করব। আপনি রোগীর অবস্থা দেখে মন খারাপ করেছেন। দেখে কষ্ট পেয়েছি। আজ সারারাত ইবাদত বন্দেগী করে রোগীর জন্যে দোয়া করব।
রোগীর নাম সাদেক। পেটে আলসার আছে, পেট ফুটো হয়ে গেছে। রক্ত বমি করছে।
ডাক্তার সাব, আপনি মনটা ঠিক করেন–আমি আল্লাহপাকের দরবারে হাত উঠাইতেছি। সাদেক নামের সেই রোগী বেঁচে গিয়েছিল। আনিস ইমাম সাহেবকে খবরটা দেবার পর তিনি আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। এই প্রকৃতির মানুষ বড় কোনো অন্যায় করতে পারে না।
মতি আছে মর্জিনার ঘরে। তার ঘরটা ছোট।। ঘর ভর্তি বিরাট এক চৌকি। চৌকিতে শীতল পাটি পাতা আছে। গৃহস্থালীর যাবতীয় সরঞ্জাম চৌকির নিচে ঢুকানো। হাঁড়িপাতিল, বালতি, টিনের ট্রাঙ্ক, পানির কলসি। দর্শনীয় বস্তুর মধ্যে আছে দুটা ফুলতোলা ওয়ারের বালিশ। মর্জিনা ময়লা বালিশে ঘুমুতে পারে না। দুটা বালিশই পরিষ্কার–ঝকঝক করছে। বালিশের ওয়ারে ফুল তারই তোলা। একটা ফুলের নিচে ইংরেজিতে লেখা MARZINA BEGUM. সূচিকর্মে তার দক্ষতা আছে এটা বুঝা যায়।
মতি বালিশে আধশোয়া হয়ে আছে। তার হাতে বিড়ি। সে আয়েশ করে বিড়ি টানছে। মর্জিনা মেঝেতে পিড় পেতে খেতে বসেছে। সে যে খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছে তা বুঝা যাচ্ছে। মতি বলল, পাখির সালুন কেমন হইছে কিছুতো বললা না।
মর্জিনা বলল, সালুন ভালো হইছে। অতি ভালো হইছে। ঝাল বেশি হইছে। কিন্তুক স্বাদ হইছে। আফনে রানছেন?
হুঁ।
আফনে হইলেন গুণের নাগর। হি হি হি।
ভাত খাওনের সময় হাসাবা না গো। খাওয়া হইল ইবাদত। ইবাদতের সময় হাসাহাসি করা ঠিক না। আল্লাহপাক নারাজ হন।
আপনে কি আইজ রাইতে থাকবেন না চইল্যা যাবেন?
বুঝতেছি না। থাকতে পারি। আবার চইল্যাও যাইতে পারি।
থাকেন, গফসফ করি।
চৌকির ওপর থেকে মার্জিনার মুখ পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। সে বসেছে। মতির দিকে পিঠ দিয়ে। কথা বলার সময় মাঝে মাঝে মতির দিকে তাকাচ্ছে তখনি তার মুখ দেখা যাচ্ছে। গোলগাল সুন্দর মুখ। বড় বড় চোখ। চোখ ভর্তি মায়া। বাজারের মেয়েদের চোখে মায়া থাকে না। এই মেয়ের চোখে এত মায়া কেন কে জানে? মতি বড়ই উদাস বোধ করল। মেয়েদের মায়া ভর্তি চোখ সব সময় তাকে উদাস করে ফেলে। আল্লাহপাক এই কাজটা ঠিক করেন নাই। মেয়েছেলের চোখে এত মায়া দেওয়া ঠিক হয় নাই। কিছু মায়া পুরুষের চোখে দেওয়া উচিত ছিল।
মর্জিনা বলল, আইজ যে পাখির সালুন দিয়া ভাত খাব চিন্তাই করি নাই। ঘরে কিছুই ছিল না। ঠিক কইরা রাখছি। শুকনা মরিচের ভর্তিা দিয়া ভাত খাব ৷
মতি বলল, রিজিক আল্লাপাকের ঠিক করা। আল্লাপাক ঠিক করেছেন তুমি আইজ পাখির সালুন দিয়া ভাত খাইবা। এইখানে তোমার আমার কিছুই করার নাই। পাখির সালুন সংসদে পাস হইয়া আছে।
তাও ঠিক।
মতি আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসল। উৎসাহের সঙ্গে বলল, ঘটনাটা চিন্তা করা–আল্লাহপাকের তরফ থাইক্যা তোমার রিজ্যিক পাস হইছে–ডাহুক পাখির সালুন দিয়া ভাত। ঠিক কি না?
হুঁ।
রিজিক পাস হইছে। বইল্যাইতো আর পাখির সালুনের বাটি আসমান থাইক্যা নাইম্যা তোমার কোলে পড়ব না? অন্য ব্যবস্থা লাগিব। ঠিক কি না চিন্তা কইরা বল।
হুঁ ঠিক।
কাজেই আল্লাপাক একটা ঝড়ের ব্যবস্থা করুল–বাড়ি ঘর উল্টাইল, মানুষের বিরাট ক্ষতি হইল, পশু পাখি মরল–ডাহুক পাখি মরল বইল্যা তুমি ডাহুক পাখির সালুন পাইলা। এখন ঘটনা চিন্তা কর–তোমারে খাওয়ানির জন্যে আল্লাপাকরে কী যন্ত্রণা করন লাগল। যা বললাম। এর মধ্যে জটিল চিন্তার বিষয় আছে। মাথা ঠাণ্ড কইরা চিন্তা কর।