লোকজনদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে তার দুটি ঘর আছে। একটা হলো বাংলা ঘর–সাধারণ পরিচিতজনারা সেখানে বসে। আরেকটা হলো ভেতর বাড়ির দিকের একটা ঘর যার নাম মাঝালা ঘর। মাঝালা ঘর ঘনিষ্ঠ জনদের জন্যে। মাঝালা ঘরে বিরাট খাট পাতা আছে। অতিথিদের খাটে পা তুলে উঠে বসতে হয়। তিনি একা কাঠের একটা চেয়ারে বসেন। চেয়ারের সামনে জলচৌকি। তিনি পা তুলে দেন। জলচৌকিতে।
আনিস ভেবেছিল চেয়ারম্যান সাহেবের মাঝালা ঘরে গিয়ে দেখবে ঘর ভর্তি লোক। সব সময় তাই থাকে। আজি ঘর ফাকা। জহির উদ্দিন খাঁ গম্ভীর মুখে পান চাবাচ্ছেন। ঠোঁটের ফাক দিয়ে পানের লাল পিক গড়াচ্ছে। চেয়ারের হাতলে রাখা গামছায় পানের পিক মুছছেন।
ডাক্তার আছ কেমন?
জ্বি ভালো।
গজব হয়ে গেছিল–এমন ঝড় আমি জীবনে দেখি নাই। এই যে বুক ধড়ফড় শুরু হয়েছে এখনো কমে নাই। আয়াতুল কুরশি পড়ার চেষ্টা করছিলাম ভয়ের চোটে সূরা ভুলে গেলাম। যতই চেষ্টা করি মনে আসে না। তুমি আসার আগে আগে মনে পড়েছে। তিনবার পড়েছি। পা তুলে আরাম করে বস ডাক্তার।
আনিস পা তুলে বসল।
একটা বালিশ নিয়ে হেলান দাও। তোমাকে আমি অত্যন্ত স্নেহ করি এইটা বোধহয় তুমি জান না। আমার রাগ যেমন বেশি, স্নেহও বেশি। ফাজিল লোকজন রাগটা দেখে, স্নেহ দেখে না। তোমার মনটা খারাপ কেন?
মন খারাপ না।
বৌমা আবার কবে আসবে?
সামনের সপ্তাহে আসার কথা। তার তো ইউনিভার্সিটি খোলা। ইচ্ছা থাকলেও ইউনিভার্সিটি ফেলে আসতে পারে না।
চেয়ারম্যান সাহেব পিক মুছতে মুছতে বললেন, স্ত্রীদের ইউনিভার্সিটি হলো তাদের স্বামী। এর বাইরে কোনো ইউনিভার্সিটি নাই। বৌমাকে আসার জন্যে চিঠি দিয়ে দাও। এই বাংলা মাসের একুশ তারিখ ধলা গ্রামে আড়ং হবে।–ষাড়ের লড়াই। শহরের মেয়ে এইসব তো দেখে নাই। দেখলে মজা পাবে। আসতে বলে দাও।
জ্বি আচ্ছা।
ষাঁড়ের লড়াই তুমি দেখেছ?
জ্বি না।
অতি মনোহর। এই বৎসর লড়াই-এ আমার নিজের ষাড় আছে। ষাড়ের নাম জুম্মা খান। দেখি জুম্মা কী করে। সরবত খাও–দিতে বলি।
জ্বি না সরবত খাব না।
খাও। খেলে ভালো লাগবে। দুধ পেস্তাবাদাম দিয়ে বানানো সরবত। বরফের কুচি দিয়ে ঠাণ্ডা করা। বরফ আনায়েছি নেত্রকোনা থেকে। বরফ অবশ্যি সরবত বানানোর জন্যে আনি নাই। আমি মাঝে মধ্যে সামান্য মদ্যপান করি। তার জন্যে বরফ লাগে। তুমি মদ্যপান করা?
জ্বি না।
তোমার আগে যে ডাক্তার ছিল–সিদিক নাম সে এই লাইনে ওস্তাদ লোক ছিল। পুরা এক বােতল একা খেয়েছে। তারপরেও কিছু হয় নাই। যাই হোক সরবত খাও।
চেয়ারম্যান সাহেব গলা উচিয়ে ডাকলেন–সরবত আন।
সরবত মনে হলো তৈরিই ছিল। চেয়ারম্যান সাহেবের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সরবতের গ্লাস নিয়ে ঘরে সতেরো আঠারো বছরের একটা মেয়ে ঢুকাল। আনিস চমকে উঠল। গ্রাম ঘরে এমন রূপবতী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। ঠোঁট পর্যন্ত লাল। লিপিস্টিকের লাল না, পানের রসের লালও না। এমিতেই লাল। যেন টোকা দিলেই রক্ত বের হবে।
চেয়ারম্যান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন–এর নাম হেনা। আমার দূর সম্পর্কের ভাইস্তি। অনাথ মেয়ে। পিতামাতা গত হয়েছে–থাকত মামার বাড়িতে। তারা খুবই অত্যাচার করত। শেষে আমার কাছে এনে রেখেছি। মেয়েটাকে ভালো করে দেখ ডাক্তার।
আনিস অস্বস্তিতে পড়ে গেল। মেয়েটাকে ভালো করে দেখার কী আছে সে বুঝতে পারছে না।
মেয়ে সুন্দর কি না বল?
জ্বি সুন্দর। ভালো করে দেখেছি তো?
জ্বি।
সিনেমার কোনো হিরুইন এই মেয়ের কাছে আনলে মনে হইব–বান্দি। ঠিক বলছি না?
ডাক্তার চুপ করে রইল।
চেয়ারম্যান সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, এখন এই মেয়ের জন্যে শহর থেকে পাত্র জোগাড় করবাে। তোমার অবিবাহিত বন্ধু বান্ধব আছে না? তাদের চিঠি দিবা। সঙ্গে কন্যার ছবি দিয়া দিবা। ময়মনসিংহ শহরে নিয়া স্টুডিওতে হেনার ছবি তুলিয়েছি। চেহারা যত সুন্দর ছবি তত সুন্দর হয় নাই। ছবি তোমার কাছে পাঠায়ে দিব।
হেন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। তার ঠোট কাঁপছে, মনে হয়। সে কেঁদে ফেলবে। জহির উদ্দিন খাঁ হেনার দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে মাছি তাড়াবার মতো ভঙ্গি করে বললেন–যা এখন ঘরে যা।
বাংলা ঘরে প্রচুর লোক সমাগম হয়েছে এটা বুঝা যাচ্ছে। জুম্মাঘরের ইমাম সাহেবের সুরেলা গলা শোনা যাচ্ছে, মিলাদ হচ্ছে–
বালেগাল উলা বে কামালিহি
হাসানুদ্দোজা বে জামালিহি
চেয়ারম্যান সাহেব আরেকটা পান মুখে দিতে দিতে তিক্ত গলায় বললেন–জুম্মাঘরের ইমাম সাহেবের বিষয়ে একটা খুবই খারাপ কথা শুনেছি। সকাল বেলা তিনি দুধ খান। হাসানের ছেলে রোজ সকালে তারে এক পোয়া দুধ দিয়া আসে। ছেলেটার বয়স আট-নয়। গত সোমবারে সে দুধ নিয়া গেছে। ইমাম সাহেব তখন ছেলের হাত ধইরা দরজা লাগায়ে দিল… ঘটনা কি ঘটল বুঝতে পারছি ডাক্তার?
আনিস কিছু বলল না। চুপ করে রইল। চেয়ারম্যান সাহেব পানের পিক মুছতে মুছতে বললেন–আমি সন্ধান নিতেছি ঘটনা। যদি সতি্যু হয়। এই গুমমরে আমি নেংটা করাইয়া গ্রামের চারদিকে চক্কর দেওয়াব। এই অঞ্চলে খারাপ লোক আমি একলা থাকব। আর কাউরে থাকতে দিব না। ডাক্তার যাও মিলাদে সামিল হও। আমি সামিল হতে পারব না। মদ্যপান করেছি। এই অবস্থায় মিলাদে যোগ দেয়া যায় না।
ডাক্তার উঠে দাঁড়াল। চেয়ারম্যান সাহেব ইশারা করে আবার তাকে বসতে বললেন—