আনিস হো হো করে হাসছে। সুজাত ঘরে ঢুকে বলল, ভাত খাইবেন না? আনিস বলল, অবেলায় আর ভাত খাব না। শরীরটা ভালো লাগছে না। এক কাপ চা খাব। আচ্ছা শোন চাও খাব না।
সুজাত শুকনা মুখে তাকিয়ে আছে। তার প্রচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে। কিন্তু সে ডাক্তার সাহেবকে ফেলে খাবে কীভাবে?
নবনীর চিঠিটা পড়তে আনিসের ভয় ভয় লাগছে। চিঠিতে কী লেখা আছে আনিস তা অনুমান করতে পারে–তারপরেও চিঠি পড়ার মতো সাহস সে সঞ্চয় করে উঠতে পারছে না। আনিস বিছানা ছেড়ে উঠল। শরীরের অসুস্থতাটাকে প্রশ্ৰয় দেওয়া ঠিক হবে না। সাইকেলে করে সে খানিকটা ঘুরবে–তারপর যাবে। শ্মশানঘাটায়। নবনীর সব চিঠিই সে শশানঘাটের নির্জনতায় পড়েছে। আজকেরটা বাদ যাবে কেন? হোক না কঠিন কোনো চিঠি।
আনিস শশানঘাটে গিয়ে খানিকটা চমকাল। কেউ একজন শ্মশানঘাটা ঝকঝাক করে রাখছে। এই কাজটা যে আজই প্ৰথম করা হচ্ছে তা-না। রোজই করা হচ্ছে। কাজটা কেউ একজন আনিসকে খুশি করার জন্যে করছে তা বোঝা যাচ্ছে। যে কাজটা করছে সে ঘটনাটা প্ৰকাশ করছে না। নবনী থাকলে চট করে বের করে ফেলত। এসব ব্যাপারে তার অসম্ভব বুদ্ধি। আনিস নবনীর চিঠি পড়তে শুরু করল।
ডাক্তার সাহেব,
কেমন আছ বল তো? শুনে খুশি হবে কি-না জানি না, আমার দুঃস্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়েছে। কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে ঢাকায় এসে দুঃস্বপ্লহীন রাত কাটাচ্ছি। স্বপ্ন-খাতাটা কুটিকুটি করে ফেলে দিয়েছি।
আমার চিঠি পড়ে কি কষ্ট পাচ্ছ? প্লীজ কষ্ট পেও না। দুঃস্বপ্ন নিয়েও যদি তোমার গলায় ঝুলে থাকতাম তাহলে কষ্টটা অনেক বেশি হতো। এখন অনেক কমের ওপর দিয়ে গেল। আমার সিদ্ধান্ত তোমার মা-কে জানাতে গিয়েছিলাম।–তিনি তোমার বিদেশ যাত্ৰা নিয়ে এতই আনন্দিত যে কথাটা বলা গেল না। বিদেশ যাবার ব্যাপারটা নিয়ে তুমি একটু চিন্তা কর তো। আমার ধারণা গ্রামে ডাক্তারির ব্যাপারটায় তুমি যতটা আনন্দ পাচ্ছ–বিদেশের ল্যাবোরেটরিতে তত আনন্দ পাবে না। তোমাকে ‘সাইকেল ডাক্তার’ হিসেবে যতটা মানায়–মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুগম্ভীর অধ্যাপক হিসেবে তত মানায় না।
তোমাদের মতি আমার কাছে গোপনে একটা পরামর্শ চেয়েছে–সে না-কি স্বপ্নে পাওয়া কি ট্যাবলেট বানাতে চাচ্ছে। ট্যাবলেট জোড়া লাগছে না। জোড়া কীভাবে লাগে জানতে চেয়েছে। তাকে বল আগার আগার গাম ব্যবহার করতে। আমি এক্সপার্ট ওপিনিয়ন নিয়েই বলছি। আগার আগার গাম পানিতে গুলে বড়ির সঙ্গে মেশাতে হবে।
তোমাদের মতি যে ইমাম সাহেব সেজে বিভিন্ন মানুষকে ভয় দেখাতো এটা জান? মহিলা শার্লক হোমসের মতো আমি রহস্যভেদ করেছি। কীভাবে করলাম বলি–আমি লক্ষ করলাম মতির হাইট এবং ইমাম সাহেবের হাইট একই। দু’জনই রোগাপাতলা ছোটখাট মানুষ। তখন আমার সন্দেহ হলো মতি বোধহয় ইমাম সাহেবের আচকান টুপি চুরি করে এই কাজটা করছে। আমি মতিকে হুট করে জিজ্ঞেস করলাম, মতি ইমাম সাহেবের আচকান টুপি চুরি করেছ কেন? মতি পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। তখন বললাম, মানুষকে ভয় দেখাও কেন? মানুষকে ভয় দেখানো কি উচিত? মাতি খুবই বিব্ৰত ভঙ্গিতে মাথা চুলকাতে লাগল।
দেখেছি আমার কত বুদ্ধি?
তোমাদের চেয়ারম্যান জহির খাঁ সাহেবের কথায় বিভ্ৰান্ত হয়ো না। তিনি অত্যন্ত চালাক মানুষ। তার চালাকির সঙ্গে তুমি পারবে না। তুমি তো জান না যে তার স্ত্রীর রহস্যময় মৃত্যু হয়েছিল। ভদ্রমহিলা কলেরায় মারা গেছেন এই ঘোষণা দিয়ে তিনি অতি দ্রুত তার স্ত্রীর কবরের ব্যবস্থা করেন। এই লোককে চট করে বিশ্বাস করা কি উচিত?
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে অতি দ্রুত তিনি তোমাকে কোনো বিপদে ফেলবেন। কারণ তিনি তার আশেপাশে ক্ষমতাবান মানুষ পছন্দ করেন না। তুমি কাকতালীয়ভাবে এই অঞ্চলের একজন ক্ষমতাধর মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছ। তুমি মানুষটা বোকা বলেই আমার ভয়।
বোকা বলছি বলে রাগ করছ না তো? তুমি বোকা তো বটেই, বোকা বলেই আমি যখন বলেছি তোমাকে আমার পছন্দ হচ্ছে না। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি–তুমি সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস করে ফেলেছ। মানুষকে এত বিশ্বাস করাও কিন্তু ঠিক না।
আমি ঢাকায় আসার সময় ট্রেনে উঠেছি–দেখলাম তুমি অন্যদিকে তাকিয়ে আছ। একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছ না। আমি প্ৰথম ভাবলাম রাগ করে তাকাচ্ছ না। তারপর হঠাৎ দেখি তোমার চোখ ভর্তি পানি। আমার কী যে আনন্দ হলো। তখন ভাবলাম, কিছুদিন তোমাকে কষ্ট দিয়ে দেখি। আনন্দকে তীব্র করার জন্যে কষ্টের প্রয়োজন আছে, তাই না?
আমার আর্কিড গাছগুলোতে ফুল ফুটলেই আমাকে খবর দেবে। আমি চলে আসব।
ডাক্তার সাহেব, তুমি আমার জন্যে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ–তার প্রতিদানে আমি ‘জনম জনম কাঁদিব।’
চিঠি শেষ করে আনিস স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এক সময় সন্ধ্যা মিলাল, রাত হলো। অন্ধকার রাত–তারপরেও আনিসের মনে হলো–অপূর্ব জোছনা হয়েছে। জোছনার তীব্ৰ আলো শ্বেতপাথরে চকমক করছে। জোছনা গায়ে মাখার জন্যে কি-না কে জানে ডাক্তারি ব্যাগ মাথার নিচে দিয়ে আনিস লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
অন্ধকার ঝোপের আড়াল থেকে মতি অবাক হয়ে দৃশ্যটা দেখছে। শ্মশানঘাট সেই ধুয়ে পরিষ্কার করে। শ্মশানঘাটায় এসে এই পাগল ডাক্তার যা করে তাই তার দেখতে ভালো লাগে। তার কাছে মনে হয় রহস্যে ভরা এই মানব জীবনটাকে লোকে যত খারাপ বলে–আসলে তত খারাপ না।