নবনী ক্যামেরার জন্যে ফিল্ম নিয়ে এসেছিল, ব্যবহার করা হয় নি। এখন ব্যবহার করা যাবে। ফিল্ম নেত্রকোনা পাঠিয়ে ডেভেলপ করে আনাতেও দু’দিন লাগবে। বিরাটনগরের কিছু ছবিও সে তুলে নিয়ে যাবে। শ্মশানঘাটের ছবি, বুধবারে যে হাট বসে–হাটের ছবি, আড়ং-এর ছবি।
বিরাটনগরে থাকার কাল শেষ হয়েছে। ট্রপিক্যাল মেডিসিনে পিএইচডি করার স্কলারশিপ পাওয়া গেছে। গবেষণার কাজটা তার কেমন লাগবে সে বুঝতে পারছে না। ডাক্তারি করে যে আনন্দ সে পেয়েছে সেই আনন্দ কি পাবে? মনে হয়। পাবে না। মানুষের ভালোবাসায় যে অভ্যস্ত হয়ে যায়। সেই ভালোবাসা না পেলে সে অথৈ জলে পড়ে যায়।
আনিসকে দেখিয়ে কেউ যখন গর্ব এবং অহংকার নিয়ে বলে–আমরার সাইকেল ডাক্তার যায়। বাক্কা বেড়ার চাক্কাডা–তখন মনে হয় কড়া কোনো নেশার বস্তু রক্তে ঢুকে গেছে। শরীর ঝনঝনি করতে থাকে।
বুধবার হাটে আনিস মাছ কিনতে গিয়েছিল। দশটা কইমাছ কিনে দাম দিতে গেলা–মাছওয়ালা এমনভাবে তাকাল যেন সে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করছে। হড়বড় করে বলল–আমি গরিব বইল্যা এই অপমান–আপনে আমারে দাম দিতে চান। কপালের দোষে গরিব হইছি ডাক্তার সাব। আইজ যদি আপনের কাছে মাছের দাম নেই। আর এই সংবাদ আমার পরিবারের কানে যায়–হে আমারে তিন তালাক দিয়া বাপের বাড়ি চইল্যা যাবে।
আনিস হাসতে হাসতে বলল, কারণ কী?
কারণ আফনে তারে বাঁচাইছিলেন। আমরা তার জীবনের আশা ছাইড়া দিয়া মৌলবি ডাকাইয়া তওবা পর্যন্ত পড়াইছি।
মানুষের ভালোবাসার বন্ধন কাটানো খুবই কঠিন। কঠিন হলেও বন্ধন কাটাতে হবে। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। আনিস সাইকেল নিয়ে পথে নামল। সাইকেলের কেরিয়ারে ডাক্তারি ব্যাগ আছে। সেই ব্যাগের এক কোনায় আছে একটা ক্যামেরা। ছবি তোলা হবে।
মসজিদের কাছে এসে আনিস সাইকেল থেকে নামল। মসজিদের নতুন ইমাম সাহেব বের হয়ে এলেন। খুবই অল্পবয়স্ক, হাসি খুশি একজন যুবক। সুন্দর চেহারা।
আনিস বলল, ইমাম সাহেব কেমন আছেন?
ইমাম বিনয়ের সঙ্গে বলল, ভালো আছি। ডাক্তার সাহেব।
আনিস বলল, একা একা থাকেন। ভয় লাগে না?
ইমাম বলল, জি না ভয় লাগে না। আল্লাহপাকের পাক কালাম পড়ে রাতে ঘুমাই–ভয় লাগবে কী জন্যে!
নতুন এই ইমামকে আনিসের খুব পছন্দ। ছেলেটা হাদিস কোরানের বইপত্র ঘেঁটে সবাইকে দেখিয়েছে, অপঘাতে যার মৃত্যু হয়েছে তার জন্যেও জানাজার নামাজ হবে। সে আগের ইমাম সাহেবের জন্যে জানাজার নামাজের ব্যবস্থা করেছে। আনিস সকিনাকে চিঠি লিখে ঘটনাটা জানিয়েছে। আনিস লিখেছে—
আপনি শুনে আনন্দিত হবেন যে আপনার বাবার জন্যে জানাজার নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মসজিদের নতুন ইমাম সাহেব ব্যবস্থা করেছেন। এবং প্রচুর লোক সমাগম হয়েছে। বিরাট নগর গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের গ্রামের মানুষরা জানাজায় শরিক হয়েছে। জানাজার পর মিলাদ হয়েছে। চেয়ারম্যান জহির খাঁ সাহেব মিলাদ উপলক্ষে দুটা গরু জবেহা করে লোকজনদের খাইয়েছেন।
আপনার শুনে খুবই ভালো লাগবে যে জহির খাঁ সাহেব মিলাদের অনুষ্ঠানে বলেছেন—‘তিনি অন্যায় করেছেন। একজন সম্মানিত মানুষকে অপমান করেছেন।’
জহির খাঁ সাহেবের শরীর ভালো না। আপনি দয়া করে তার ওপর কোনো রাগ রাখবেন না।
ক্লিনিকের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে আনিস কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল। তার নিজের শরীরও ভালো যাচ্ছে না। অল্পতেই ক্লান্তি লাগে। এই ক্লান্তি মনের না শরীরের তাও সে বুঝতে পারছে না। জটিল কোনো ব্যাধি কি শরীরে ঢুকে পড়েছে। যে ব্যাধিকে সে নিজে সাইকেলে ঘণ্টা বাজিয়ে দূর করতে পারবে না। প্রকৃতি মানুষকে নিয়ে নানান খেলা খেলে। প্রকৃতি হঠাৎ যদি চায়…
আনিস ঘুমিয়ে পড়ল। তার দুপুরের খাওয়া হলো না। সুজাত মিয়া রান্না করে বসে রইল। মানুষটা না খেয়ে ঘুমাচ্ছে–সে কী করে খায়। সুজাতের পায়ে চকচকে নতুন জুতা। এই জুতা আনিস অর্ডার দিয়ে ঢাকা থেকে বানিয়েছে। জুতার হিল একটা বড়, একটা ছোট। এই জুতা পরে সুজাত অন্য সবার মতো সাধারণভাবে হাঁটতে পারে। পায়ে জুতা পরা অবস্থায় তার হাঁটা দেখে কেউ বলতেই পারবে না। তার পায়ে কোনো সমস্যা আছে। জুতা পরে হাঁটতে তার খুবই লজ্জা লাগে। সে হলো ফকিরের বাচ্চা, কিন্তু পায়ে চকচকা জুতা। আবার এই জুতা পরে হাঁটতেও তার ভালো লাগে। একদিন জুতা পরে সে একটা দৌড় দিয়েছিল। কোনো সমস্যা হয় নি।
সুজাত শুনেছে আনিস চলে যাবে। সুজাত এই নিয়ে কিছু বলে নি। তবে সে ঠিক করে রেখেছে। ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে সেও যাবে। বিলাত, লন্ডন, যেখানেই হোক যাবে। বিরাটনগর ছেড়ে সে থাকতে পারবে না। ডাক্তার সাহেব যদি তাকে নিতে না চান তাহলে সে এই জুতা জোড়া পরবে না। মগড়া নদীতে ভাসিয়ে দেবে। এটা তার মুখের কথা না, সে জুম্মা ঘর ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে।
দুপুরের ডাকে আনিস দুটা চিঠি পেয়েছে। একটা তার মা লিখেছেন, আরেকটা নবনী। মা’র চিঠিটা আনিস বিছানা থেকে না নেমে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে ফেলল। মা লিখেছেন–
বাবা তুমি পিএইচডি করতে বাইরে যাচ্ছ শুনে খুবই আনন্দিত হয়েছি। তোমার বাবা তার স্বভাবমতো এটা নিয়েও নানাবিধ যন্ত্রণা করছেন–তুমি আমেরিকার যে স্টেটে যাচ্ছ তার আবহাওয়া এবং তার জলবায়ু নিয়ে বইপত্র এনে নানান ধরনের গবেষণা শুরু করেছেন এবং তিনি তার জ্ঞানের নমুনা আমাকে দেখাতে শুরু করেছেন। রাত তিনটার সময় কেউ যদি আমারে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলে–মেরিল্যান্ডে ডিসেম্বর মাসেও বরফ পড়ে না। গত বছর ক্রিসমাসের সময়ও বরফ পড়ে নি। তখন কেমন লাগে। তুমিই বলো। এই নিয়ে আমি দু একটা কঠিন কথা বলেছি–তার ফলে তোমার বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। এখন তিনি আছেন উত্তরায় তার খালাতো ভাই পারভেজ সাহেবের বাসায়। সেখান থেকে নিয়ম করে প্রতিদিন টেলিফোনে আমার সঙ্গে ঝগড়া করছেন। যতই বয়স বাড়ছে। ততই তোমার বাবা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছেন। শুনেছি। তুমি খুব ভালো ডাক্তার হয়েছ–তোমার বাবার জন্যে অবশ্যই ওষুধের ব্যবস্থা করবে।