আনিস বলল, আমি কিছু বিশ্বাস করি না। আবার কোনো কিছু অবিশ্বাসও করি না। আমি শুধু একটা জিনিসই জানি–প্ৰাণী হিসেবে মানুষ খুবই অদ্ভুত।
কোনো প্রাণীই তার স্বজাতিকে হত্যা করে না। শুধু মানুষ করে।
মাটির হাঁড়ির মুখ কলাপাতা দিয়ে বাঁধা।
বাঁধন খুলতে খুলতে মরজিনার চোখ চকচক করতে লাগল। সে আদুরে গলায় বলল, আইজ আবার কী আনছেন?
মতি উদাস গলায় বলল, জানি না। কী আনছি। খুইল্যা দেখ।
জিনিসটা কী চিনতেছি না তো। মুখে দিয়া দেখ।
মরজিনা বলল, দেখতে জানি কেমন। ঘিন্না ঘিন্না লাগতেছে।
ঘিন্না লাগলে খাইও না। সবেরে সব জিনিস সয়না। ঘি খাইলে কুত্তার লোম পইড়া যায়। জিনিসটা হইল তেলিকান্দির সরভাজা।
তেলিকান্দির সরভাজা?
নাটোরের কাঁচাগুল্লা, পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই যে রকম–তেলিকান্দির সরভাজাও একই রকম। রমেশ কারিগরের সাক্ষাত নাতি ওস্তাদ পরমেশ কারিগরের নিজের হাতে পাক দেওয়া জিনিস। ঢাকা শহরের রাইস আদমীরা নগদ টেকা দিয়া এই জিনিস নিয়া যায়। সাতদিন আগে অর্ডার দেওন লাগে। বহুত ঝামেলা কইরা তোমার জন্যে জোগাড় করছি। তুমি জিনিস চিনলা না, আমার আর করনের কী আছে! এইটা হইল আমার কপাল।
মরজিনা আঙ্গুলের ডগায় খানিকটা সরভাজা মুখে দিল। মতি বলল,
গন্ধ ভালো না, কিন্তু খাইতে ভালো।
খাওয়াটাই আসল, গন্ধ কিছু না। গু যদি খাইতে ভালো হইত–মানুষ নাকে চাপ দিয়া সমানে গু খাইত।
মরজিনা আগ্রহ করে খাচ্ছে। মতির এই দৃশ্য দেখতে বড় ভালো লাগছে। আহারে বেচারি! ভালো মন্দ খাইতে এত পছন্দ করে সেই ভালো মন্দ খাওয়ার ব্যবস্থাই তারে আল্লাহপাক দেয় নাই।
তেলিকান্দির সরভাজা যে আসলে ওস্তাদ পরমেশ কারিগর বানায় নি, মতি নিজে বানিয়েছে–এটা বলতে ইচ্ছা করছে। মতি চায়ের দোকান থেকে তিন কাপ দুধের সর কিনে নিয়ে সোয়াবিন তেলে ভেজে ফেলেছে। সঙ্গে চার চামচ চিনি দিয়েছে। তেজপাতা ছিল না বলে দেওয়া হয় নি। কড়াই থেকে কালো রং ওঠায় জিনিসটা দেখতে বিদঘুটে হয়েছে। তাতে ক্ষতি কী? খাওয়া হলো আসল। মতি বলল, মরজিনা মজা পাইছ?
মরজিনা বলল, আরেকবার আনন লাগব।
মতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চেষ্টা নিব। পারব কি-না বলতে পারি না। পরমেশ কাগিগররা আমার মতো দুই পয়সা দামের মানুষ ক্যামনে ধরে কও দেখি।
একবার যখন ধরতে পারছেন, আরেকবার পারবেন।
দেখি চেষ্টা নিব।
মরজিনা বলল, আমারে সোনার কিছু কিন্যা দিয়েন–মেয়েছেলের শইল্যে সোনার কোনো জিনিস না থাকলে দোষ লাগে। এমন সুন্দর সোনার একটা নাকছবি ছিল–কই যে পড়ছে!
মতি বলল, চিন্তা নিও না। দিব সোনার নাকছবি। স্বাধীন ব্যবসায় নামতেছি–টেকা পয়সার চিন্তা আর থাকব না।
কী ব্যবসা?
স্বপ্নে একটা বড়ি বানানির হিসটোরি পাইছি। এই বড়ি বেচব। বড়ির নাম–জ্বরমতি। এই বড়ি দুইটা খালি পেটে খাইলে যে-কোনো জ্বর দুই ঘণ্টার মধ্যে আরোগ্য হয়।
টেকা পয়সা হইলে কি আর আপনে আমারে পুছবেন? আমি কে?
আমি অবশ্যই তোমারে পুছব। ট্যাহা পয়সা হইলে তোমারে বিবাহও করতে পারি। অনেক দিন থাইক্যা সংসার করতে ইচ্ছা করে। টেকা পয়সার অভাবে সংসার করতে পারতেছি না।
আমার মতো একটা খারাপ মাইয়ারে আফনে সত্যই বিবাহ করবেন?
অবশ্যই করব। তুমি যেমন খারাপ আমিও তেমন খারাপ। খারাপে খারাপে কাটাকাটি।
আনন্দে মরজিনার চোখে পানি এসে গেল। মতি গভীর আবেগের সঙ্গে বলল–কানবা না। দুই দিনের দুনিয়োত আসছি আনন্দ ফুর্তি কইরা যাও। আমার মন খুবই খারাপ। তোমার চউক্ষের পানি দেখলে আরো খারাপ হইব।
মন খারাপ কী জন্যে?
ইমাম সাব আছে না। সে আইজ একটা লোক মাইরা ফেলছে।
কী কন আপনে?
খুবই খারাপ অবস্থা। আর গেরামে যাব না বলে ঠিক করেছি।
থাকবেন কই?
তোমার এইখানে থাকব। স্বামীরে তো তুমি ফেলতে পারব না। না-কি ফেলবা?
স্বামী আবার কখন হইলেন!
এখনো হই নাই—একদিন তো হইব। হইব না?
মরজিনা হাসছে। লাজুক হাসি। মতির দেখতে বড় ভালো লাগছে। না, সংসার ধর্মটা করা দরকার। শুধু যদি বড়িগুলা আস্ত থাকত। পাউডার হয়ে না। যেত। সংসার ধর্মের আগে বড়ি ঠিক করতে হবে। ডাক্তার সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করলে হয়। বড় বুদ্ধি এই মেয়ের। বুদ্ধিতে ঝকঝকি করতেছে। সেই তুলনায় মরজিনার বুদ্ধি–গরু ছাগলের চেয়ে সামান্য বেশি। তাও খুব বেশি না। দুই আঙ্গুল বেশি। অন্তরে মায়া মুহকবত নাই। ভালো ভালো খাওন যদি কেউ দেয়। তার জন্য মায়া মুহকবত আছে। খাওন নাই, মায়া মুহকবতও নাই। আজিব মেয়ে মানুষ। সব মেয়ে মানুষই আজিব—মরজিনা একটু বেশি আজিব। আল্লাপাকের দুনিয়াটাই আজিব।
মরজিনা বলল, কী চিন্তা করেন?
আল্লাপাকের আজিব দুনিয়া নিয়া চিন্তা করি।
মরজিনা বলল, একটা জিনিস খাইতে খুব মনে চায়–গরম বুন্দিয়া। লুচি দিয়া বুন্দিয়া। মতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল–কী মেয়েছেলে, কোনো ভালো চিন্তা নাই। তার চিন্তা–গরম বুন্দিয়া। এমন মেয়েছেলে নিয়ে সংসার করা কঠিন হবে। খুবই কঠিন। ভাবের কথা বললে কিছুই বুঝবে না। মতির মাঝেমধ্যে ভাবের কথা বলতে ভালো লাগে। লুচি-বুন্দিয়া নিয়া কতক্ষণ আর কথা বলা যায়? মতি বড়ই উদাস বোধ করল।
জনম জনম কাঁদিব
আনিসের ঘরের বারান্দায় ঝুলানো চারটা অর্কিড গাছেই ফুল ফুটেছে। নীল ফুল। লম্বা বড় বড় সতেজ অহংকারি পাপড়ি। আনিস মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। স্বপ্নে আর্কিড গাছে ফুল ফুটতে সে দেখেছে। স্বপ্লের ফুল থেকে আলো ঠিকরে বের হচ্ছিল। বাস্তবের ফুলগুলি থেকে আলো ঠিকরে বের হচ্ছে না, কিন্তু দেখতে স্বপ্নের ফুলের চেয়েও সুন্দর লাগছে। আনিস ঠিক করল–অর্কিড গাছে ফুল ফোটার খবরটা নবনীকে জানাবে। কয়েক লাইনের চিঠি–তুমি যে অর্কিডগুলি দিয়েছিলে সেখানে ফুল ফুটেছে। এই সঙ্গে গাছের কিছু ছবি।