নবনী,
আমাদের এখানে আজ হঠাৎ করে টর্নেডোর মতো হলো। টর্নেডোর স্থায়িত্ব ছিল কম। দুই থেকে আড়াই মিনিট হবে। তবে এই কিছুক্ষণেই যা ঘটেছে তার নাম লণ্ডভণ্ড। ছবি তুলে রাখলে তুমি দেখতে পেতে। ফিল্ম ছিল না বলে ছবি তোলা হয় নি। এখানের বাজারে ফিল্ম পাওয়া যায় না। ফিল্যের জন্যে লোক পাঠাতে হয় নেত্রকোনায়। তোমার যদি মনে থাকে তাহলে ফিল নিয়ে এসো। এই আজ অঞ্চলে মাঝে মাঝে সুন্দর সুন্দর ব্যাপার ঘটে যার ছবি তুলতে ইচ্ছে করে।
আমার খবর ভালো। হাসপাতালে প্রচুর রোগী আসে। তেমন কোনো কারণ ছাড়াই আমার ধন্বন্তরী ডাক্তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। এরা আমার নাম কি দিয়েছে জান? আমার নাম দিয়েছে–‘সাইকেল ডাক্তার’। একটা সাইকেল নিয়ে ঘোরাফেরা করি এই জন্যেই এই নাম। ভাগ্যিস ঘোড়ার পিঠে চড়ি না। চড়লে এরা নাম দিত ‘ঘোড়া ডাক্তার’। আমার বিষয়ে যে মজার ব্যাপারটি ছড়িয়েছে সেটা হলো–যখন আমি ভিজিটে যাই এবং রোগীর বাড়ির সামনে সাইকেল থেকে নেমে ঘণ্টা দেই ঠিক তখনি সাইকেলের ঘণ্টা শুনে রোগীর রোগ সেরে যায়। ওষুধপত্র কিছুই লাগে না। আমি খুব ভয়ে ভয়ে আছি–অচিরেই এরা হয়তো আমাকে ‘সাইকেল ডাক্তার’ ডাকা বন্ধ করে ‘ঘন্টা ডাক্তার’ ডাকা শুরু করবে।
তুমি যে চারটা অর্কিড দিয়ে গিয়েছিলে সেইগুলো বারান্দার যে জায়গায় ঝুলাতে বলেছ সেখানেই কুলানো হয়েছে। যেভাবে যত্ন করতে বলেছ সেভাবেই যত্ন করছি। তোমার হিসেব মতো গত মাসেই গাছগুলোতে ফুল আসার কথা। এখনো কিন্তু আসে নি। হঠাৎ করে অর্কিন্ডের প্রসঙ্গ কেন এল–বলি। পরশু রাতে স্বপ্নে দেখি গাছগুলোতে ফুল ফুটেছে। স্বপ্নের ফুল বাস্তবের ফুলের চেয়েও সুন্দর হয়। স্বপ্নে দেখলাম গাছগুলোতে শুধু যে নীল রঙের ফুল ফুটেছে তা না। ফুলগুলো চাঁদের জোছনার মতো চারপাশে আলো ছড়াচ্ছে। আমি খুবই ব্যস্ত হয়ে এই অপূর্ব দৃশ্য তোমাকে দেখাবার জন্যে ডাকাডাকি করছি। তুমি যে এখানে থাক না এটা আমার মনে নেই।
আমার চিঠি পড়ে তোমার কি হাসি পাচ্ছে? মনে হচ্ছে ডাক্তারের ভেতর কাব্য ভাব চলে এসেছে? কিছুটা যে আসে নি তা-না। রোগ শোক ছাড়াও ইদানীং আমি আরো অনেক কিছু নিয়ে ভাবি। কিছু কিছু ভাবনা বেশ উদ্ভট।…
হঠাৎ একসঙ্গে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতে শুরু করল। লোক বসতির বাইরে যেসব বিবি ডাকে তাদের গলার জোর অনেক বেশি। তারা একসঙ্গে ডাকতে শুরু করে, আবার হঠাৎ করে একসঙ্গে থেমে যায়। একজন শুধু থামে না। সে ডেকে যেতেই থাকে। সে সম্ভবত বিবি পোকাদের লীডার।
আনিস উঠে দাঁড়াল। রাত হয়ে গেছে। কোয়ার্টারে ফেরা দরকার। কৃষ্ণপক্ষ চলছে। অন্ধকারে সাইকেল চালানো কষ্টকর ব্যাপার। রাস্তাটা খানাখন্দে ভরা। সাইকেল টেনে টেনে নিয়ে যেতে হবে।
কাঠগোলাপের গাছে সাইকেল হেলান দিয়ে রাখা হয়েছিল। সেখানে শতশত জোনাকি পোকা জ্বলছে–সাইকেল নেই। আনিসের বিস্ময়ের সীমা রইল না। কেউ একজন চুপিচুপি সাইকেল নিয়ে চলে গেছে। সাইকেলটা তার শখের জিনিস ছিল। পোষা কুকুরের ওপর। যেমন মায়া পড়ে, সাইকেলের ওপরও সে রকম মায়া পড়ে গেছে। আনিস খুবই অবাক হয়ে লক্ষ করলতার রাগ লাগছে না। মন খারাপ লাগছে। জোনাকি পোকাগুলো বাক বেঁধে উড়ছে। অতি সুন্দর দৃশ্য। এই দৃশ্যও মন টানছে না। আনিস হাঁটতে শুরু করল। জোনাকি পোকাগুলো পেছনে পেছনে আসছে। এরা সরাসরি উড়ছে না। ঢেউ-এর মতো ওঠানামা করছে। আনিস আরেকটা সিগারেট ধরাল। সাইকেলের শোক ভোলার চেষ্টা করতে হবে। মাথায় অন্য কোনো চিন্তা ঢুকাতে হবে। জোনাকি পোকা নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে। মানুষ কি কখনো জোনাকি পোকা পোষ মানাতে পেরেছে? মানুষের পক্ষে অসম্ভব কিছু নেই। পশু, পাখি, মৌমাছি যে পোষ মানাতে পারে—, জোনাকি পোকা সে পোষ মানাতে কেন পারবে না? মানুষ বিচিত্র সব জিনিস চেষ্টা করে দেখে–এই চেষ্টাটা কেউ কি করে নি? জোনাকি পোকা পোষ মানানো গেলে সে কিছু জোনাকি পোষ মানাতো। নবনী এবং সে অন্ধকারে বসে গল্প করবে, আর তাদের দু’জনের মাঝখানে পাঁচশ জোনাকি জ্বলবে নিভবে।
তীক্ষ্ণ গলায় হঠাৎ কে যেন কথা বলল।
কেডা গো ডাক্তার সাব না?
আনিস থমকে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে ঝোপের মধ্যে কেউ ঘাপটি মেরে বসে আছে। ভয় দেখানোর জন্যে আচমকা কথা বলে উঠেছে।
ডাক্তার সাবা ডরাইছেন?
না।
আমি বদি। চেয়ারম্যান সাব আফনেরে বেচায়েন হইয়া খুঁজতেছে।
ও আচ্ছা।
কোনোখানে খুঁইজ্যা পাই না। শেষে মনে হইল–আফনে আছেন শশানঘাটায়। চইল্যা আসলাম।
ভালো করেছ।
দূর থাইক্যা দেখছি আপনে আসন্তাছেন–তখন ভাবলাম দেখি আমরার ডাক্তার সাবের সাবাস কেমন। কড়ই গাছের নিচে লুকাইয়া বইস্যা ছিলাম।
চেয়ারম্যান সাহেব কেন ডেকেছেন জান?
থানা খাইবার জন্যে ডেকেছেন। উনি একলা খানা খাইতে পারেন না। আইজ খানার আয়োজন ভালো। খাসি জবেহ হয়েছে।
ও।
ঝড় হয়েছে যে এই জন্যে জানের ছদকা। চেয়ারম্যান সাব ঝড় তুফান খুব ভয় পায়।
তুমি ভয় পাও না?
আমিও ভয় পাই। গরিবের ভয় নিয়া কোনো আলাপ হয় না। বড়লোকের ভয় নিয়া আলাপ হয়। দেন ব্যাগটা আমার হাতে দেন।
থাক।
থাকব ক্যান। আপনে ব্যাগ নিয়া কষ্ট কইরা হাঁটবেন। আর আমি বাবুসাবের মতো হাত পাও নাচাইয়া হাঁটব এইটা হয় না।
বদি জোর করে ব্যাগ নিয়ে নিল।
চেয়ারম্যান সাহেবের নাম জহির উদ্দিন খা। বয়স ষাটের কাছাকাছি। শক্ত সমর্থ চেহারা। জীবনের বেশির ভাগ সময় মানুষকে ধমক ধামক দিয়ে পার করেছেন বলে চেহারায় ধমকের স্থায়ী ছাপ পড়ে গেছে। শান্ত ভঙ্গিতে যখন বসে থাকেন তখনও মনে হয় সামনের মানুষটাকে ধমকাচ্ছেন।