ডাক্তার।
জ্বি।
আমি পিশাচ না। আমি কথায় কথায় বলি–আমি দুষ্ট লোক। আমি চাই লোকে আমারে দুষ্ট লোক ভাবুক। এতে আমার কাজের সুবিধা হয়। আমি দুষ্ট লোক এইটা সত্য, তবে যতটা বলি ততটা না। আমার কথা কি তুমি মন দিয়া শুনতেছ?
জ্বি শুনছি।
এখন শোন–আমি কী দেখলাম। রাত বাজে একটা। আমার ঘুম আসতেছে না। প্রতিরাতে আমি মদ্যপান করি। এইটা করলাম না। আমার বাড়ির পিছনে একটা লিছু গাছ আছে তুমি দেখেছি কি-না জানি না। বিরাট গাছ। গাছের তলাটা আমি বঁধায়ে দিয়েছি। মন টন খারাপ থাকলে মাঝে মাঝে সেখানে বসি। বসে আছি–হঠাৎ দেখি ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক দিয়ে কে যেন আসতেছে। ছোটখাট একজন মানুষ। হেলতে দুলতে আসতেছে। মাঝে মাঝে দাঁড়ায়। চারদিকে তাকায়। তারপর হাঁটা ধরে। আমি তাকায়ে আছি–তারপর দেখি যে দিক থেকে আসছিল। সে আবার সেই দিকে হাঁটা ধরেছে। কিছুক্ষণ পরে তারে আর দেখা গেল না। আমি ভাবলাম চোখের ধান্ধা। একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেটে দুটা টান দিয়েছি–দেখি সে আবার আসতেছে।
আমার বুক ধ্বক করে উঠল। কারণ আমি মানুষটারে ভালোমতো চিনেছি। আমাদের ইমাম সাহেব। আমার হাতে আছে একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ। ডাক্তার আমি ভীতু লোক না। আবার খুব যে সাহসী তাও না। আমি টর্চ হাতে আগায়ে গেলাম। লোকটা কাছাকাছি আসলে তার মুখে টর্চ ফেলব।
আগে সে যেভাবে আসতেছিল এখনো সেভাবেই আসতেছে। মাঝে মাঝে দাঁড়ায়। এইদিক ঐ দিক চায় আবার হাঁটা শুরু করে। লোকটা আমার কাছাকাছি আসতেই আমি তার গায়ে টর্চ ফেললাম। যা ভেবেছিলাম–তাই। ইমাম ইয়াকুব। গাল ভর্তি দাড়ি। পরনে আচকান, পায়জামা, মাথায় টুপী। টর্চ ফেলতেই ইমাম উল্টা দিকে দৌড়াতে শুরু করল। আমি টর্চ ধরেই আছি। দেখলাম সে আসলে দৌড়াচ্ছে না–বাতাসের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এই হলো ঘটনা।
আপনি কি করলেন–বাড়িতে চলে এলেন?
না। আমি লিচু গাছের নিচে আবারো গিয়া বসলাম। বাড়ি থেকে দোনালা বন্দুক নিয়ে আসলাম। টোটা ভরলাম। ঠিক করলাম আবার যদি সে আসেগুলি করব।
এসেছিল?
আর আসে নাই। রাত তিনটার সময় খবর পাইলাম দুৰ্ঘটনা ঘটেছে। তারপর থাইক্যা নিঃশ্বাসের কষ্ট।
এখন একটু কম না?
হ্যাঁ এখন কম।
আপনি শুয়ে থাকুন। ঘুমাবার চেষ্টা করুন। আপনার ঘুম দরকার।
ডাক্তার তোমারে কথাগুলো বলতে পেরেছি। আমার হালকা লাগতেছে।
হেনা আবারো মাথা বের করেছে। জহির খাঁ ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, ডাক্তার তুমি এই মেয়ের গালে ঠাশ কইরা একটা চড় মার। বড় ত্যাক্ত করতাছে। হেনা সরে গেল না। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকল।
ইমাম সাহেবের চালা ঘরে বাতি জ্বলছে। আনিস সাইকেলের বেল টিপতেই সকিনা বের হয়ে এল। তার মাথা কালো চাদরে ঢাকা। চাদরের ফাঁক দিয়ে মুখ বের হয়ে আছে। সেই মুখ ভয়ে ছোট হয়ে আছে।
আনিস বলল, আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার নাম…
মেয়েটি আনিসকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আমি আপনেরে চিনি। বাপজান আপনার কথা আমাকে চিঠিতে লিখেছেন।
আপনি একা একা ভয় পাচ্ছেন কি-না দেখতে এসেছি।
সকিনা বলল, আমার ভয় কম। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছি। আমি খুবই ভয় পেয়েছি। আমার ব্যাপজান মানুষ মারতেছে এটা কেমন কথা।
আনিস বলল, এটা খুবই ভুল কথা। এটা নিয়ে আপনি মোটেই দুঃশ্চিন্তা করবেন না। আপনি বরং এক কাজ করুন–আমার বাসায় চলুন। আমার স্ত্রী আছে। আপনার থাকতে সমস্যা হবে না। আমার স্ত্রী কাল সকালে ঢাকা চলে যাবে। আমার মনে হয় আপনারাও চলে যাওয়া ভালো।
বাপজানরে এইভাবে ফেলে রেখে চলে যাব? বাপজানের মৃত্যুর কোনো বিচার হবে না?
আনিস কী বলবে বুঝতে পারল না। সকিনা বলল, সবাই আপনাকে খুব ভালো পায়। আমার ব্যাপজান চিঠিতে লিখেছিলেন। আপনি ফিরিশতার মতো মানুষ। আপনি যদি আমাকে চলে যেতে বলেন আমি চলে যাব।
আনিস বলল, আমি আপনাকে চলে যেতেই বলছি। কারো ওপর কোনো রাগ না রেখে আপনি চলে যান।
সকিনা বলল, আচ্ছা আমি চলে যাব। তবে রাতটা এখানেই থাকব।
ভয় পাবেন না?
না, ভয় পাব না। জহির উদ্দিন খাঁ সাহেব আমার জন্যে পাহারার ব্যবস্থা করেছেন। তার হুকুম মতো আমার সঙ্গে একজন মহিলা থাকেন। মসজিদে একজন পুরুষ মানুষ থাকে।
তাই না-কি?
তিনি এই কাজটা প্রথম দিন থেকেই আমার জন্যে করেছেন। কেন করেছেন তা আমি জানি না। দুই বেলা আমার জন্যে তিনি ভাত তরকারি পাঠান। একটা কথা আছে না–গরু মেরে জুতা দান। আমার মনে হয় ব্যাপারটা সে রকম।
আনিস বলল, সে রকম তো নাও হতে পারে। হয়তো যে কাজটা উনি করেছেন তার জন্যে তিনি অনুতপ্ত। হয়তো আপনাকে দেখে তার মায়া লেগেছে। আমার ধারণা লোকে উনাকে যতটা খারাপ ভাবে তত খারাপ উনি না।
সকিনা কঠিন গলায় বলল, আমার বাবাই শুধু খারাপ। খারাপ কাজ করে সে শাস্তি পেয়েছে। মৃত্যুর পরেও খারাপ কাজ করছে। মানুষ মারছে। কিছু মনে করবেন না ডাক্তার সাহেব মনের দুঃখে কিছু কঠিন কথা বললাম।
আমি কিছু মনে করি নি।
সকিনা। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমি হাসান নামের লোকটার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু কথা বলতে পারলাম না। জহির খাঁ সাহেব হাসানকে আর তার ছেলেকে দূরে কোথায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি চান না আমি তার সঙ্গে কথা বলি।
আনিস বলল, পুরনো প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলার দরকার কী?
সকিনা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কেন, আপনি কি বিশ্বাস করেন ঘটনা সত্যি?