নবনী বলল, আপনাদের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছে?
তিনি বললেন, হ্যাঁ। এক সপ্তাহ ধরে কথাবার্তা বন্ধ। আবার যে কথা বলা শুরু করব এটাও মনে হচ্ছে না। মা তুমি কি আরেকটা কাজ করতে পারবে, হায়নাটাকে বলবে যে আজ থেকে আমি তার খাবার মুখে দেব না। হোটেল থেকে খাবার এনে খাব। কথাটা বলতে পারবে? বলতে পারলে খুব ভালো হয়।
নবনী হাসতে হাসতে বলল, পারব।
দুপুরে খেতে বসে নবনী অবাক হয়ে দেখল আনিসের বাবা সত্যি সত্যি হোটেল থেকে বিরিয়ানী নিয়ে এসেছেন। একই টেবিলে বসে খুব আয়োজন করে খাচ্ছেন। নবনীর খুবই মজা লাগল।
আনিসের মা’র এই মেয়েটিকে এতই পছন্দ হলো যে দুপুরে খেতে বসেই তিনি ঠিক করলেন–যে করেই হোক এই মেয়েটির সঙ্গেই আনিসের বিয়ে দিতে হবে। তার আগ্রহেই শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়। নবনীর দিক থেকেও হয়তো আগ্রহ ছিল। আনিসের আগ্রহ অনাগ্ৰহ কিছুই ছিল না।
যে মেয়ে মনে মনে অন্য একজনকে অনুসন্ধান করছে তার প্রতি আগ্ৰহ তৈরি হবার কথাও না। নবনী হয়তো ভেবেছিল এই আনিস তার কল্পনার আনিসের কাছাকাছি যাবে। সেটা সম্ভব হয় নি। নবনীর কল্পনার মানুষটা কেমন আনিস তা জানে না। কল্পনার মানুষের চরিত্রে অভিনয় সে করতে পারে নি। ইচ্ছাও হয় নি।
জহির খাঁর বাড়ির উঠোন ভর্তি মানুষ। সব ক’টা ঘরে হারিকেন জ্বলছে। পল্পী বিদ্যুতের কানেকশন থাকলেও আজ ইলেকট্রিসিটি নেই। দুটা হ্যাজাক বাতি জ্বলিয়ে অন্ধকার প্রায় দূরই করে দেয়া হয়েছে। একটা হ্যাজাক বাতি জ্বলছে মাঝলো ঘরের উঠোনে। আরেকটা মূল বসত বাড়ির বারান্দায়।
জহির খাঁ সাধারণত মাঝালা ঘরেই সময় কাটান। আজ তিনি শুয়ে আছেন। নিজের ঘরের পালংকে। সেখানে বাইরের লোকজনের প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কিন্তু আনিসকে সরাসরি সেখানেই নিয়ে যাওয়া হলো।
ঘরে বিশাল এক রেলিং দেয়া খাট। খাটে তিনটা বালিশ পেতে আধশোয়া হয়ে জহির খাঁ এলিয়ে পড়ে আছেন। তার গায়ে তসরের হলুদ রঙের চাদর। চাদরের নিচে একটু পরে পরেই তিনি কেঁপে কেঁপে উঠছেন। খাটের রেলিং ধরে হেনা চিন্তিত এবং ভীত চোখে দাঁড়িয়ে আছে। জহির খাঁর চোখ লাল তবে তিনি নেশাগ্ৰস্ত না। ঘরে এলকোহলের গন্ধ নেই। কর্পূরের গন্ধ আছে।
আনিস বলল, আপনার কি শরীর খারাপ করেছে?
জহির খাঁ বললেন, শরীর ভালো না খারাপ সেই আলাপ পরে হবে। তুমি ঐ চেয়ারটায় বস।
হেনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, উনার শরীর খুবই খারাপ।
জহির খাঁ ধমক দিয়ে বললেন, তোমারে কে কথা বলতে বলছে? আমার শরীর ভালো না মন্দ সেইটা আমি বুঝব। ঘর থ্যাইকা যাও।
হেনা চোখ মুখ শক্ত করে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েই রইল। জহির খাঁ প্ৰচণ্ড ধমক দিলেন–কঠিন গলায় বললেন, যাও ঘর থাইক্যা। হেনা বের হয়ে গেল। জহির খাঁ বললেন, ডাক্তার এখন তুমি আমারে পরীক্ষা-টরীক্ষা যা করার করা।
আনিস কাছে গেল। গায়ে জ্বর নেই। বরং গায়ের তাপ স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য কম। তবে নাড়ি খুব দ্রুত চলছে। প্রায় একশ’র কাছাকাছি। মাঝে মাঝে ড্রপবিট হচ্ছে।
জহির খাঁ বললেন, কি দেখলা? আনিস বলল, গায়ে জ্বর নেই। তবে নাড়ি দ্রুত চলছে। আপনি কোনো একটা বিষয় নিয়ে খুব উত্তেজিত।
বিষয়টা কি তুমি অনুমান করতে পার?
জ্বি না। আমার অনুমান শক্তি ভালো না।
জহির খাঁ বিছানায় উঠে বসলেন। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমারে আমি অত্যধিক স্নেহ করি বলেই বলতেছি। নয়তো বলতাম না। ডাক্তার শোন, আমি সব সময় নানান উত্তেজনার মধ্যে থাকি। উত্তেজনায় থাকা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। এতে আমার শরীর খারাপ করে না। ঘটনা ভিন্ন। তুমি আমার ঘটনোটা আগে শোন–তারপরে চিকিৎসা করা। বুঝতে পারতেছি আমার চিকিৎসা দরকার। আমার শরীর অতিরিক্ত খারাপ। নিঃশ্বাস নিতে পারতেছিলাম না। তুমি বাড়ির কাছে আইসা সাইকেলের ঘন্টা দিলা তারপর থাইক্যা নিঃশ্বাস নিতে পারতেছি।
হেনা আবার এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছে। জহির খাঁ প্ৰচণ্ড ধমক দিলেন–আবার কেন আসছ?
ধমকে হেনা কেঁপে উঠল, কিন্তু খাটের রেলিং ধরেই থাকল। আনিস বলল, আপনি এখন যান। উনার মেজাজ ঠিক হলে আসুন। চেয়ারম্যান সাহেবের হার্টের অবস্থা ভালো না। এই সময় তাঁকে আর উত্তেজিত করা ঠিক হবে না।
হেনা চলে গেল। তবে তার চোখ ভর্তি পানি। অস্বাভাবিক একটা দৃশ্য।
জহির খাঁ গলা নিচু করে বললেন, ডাক্তার শোন, আজ আমি ইমাম সাহেবরে দেখলাম। আচকান পাঞ্জাবি পরা। মাথায় টুপী।
আনিস কিছু বলল না।
জহির খাঁ বললেন, ঘটনাটা বলার আগে তোমার কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। এই যে আজিজ মিয়া পানিতে ড়ুইব্যা মারা গেছে–এই বিষয়ে তোমার অনুমান কী? কেন মরল?
আপনাকে আগেই বলেছি–আমার অনুমান শক্তি দুর্বল।
জহির খাঁ বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, অনেকেই মনে করবে কাজটা আমি করায়েছি। ভয় দেখায়ে তারে পানিতে নিয়া ফেলছি–ঘটনা সত্য না। আমি মানুষরে শাস্তি দেই। সেই শাস্তির মাপ আছে। কানে ধরে উঠবাস করাই, মাঠে চক্কর দেওনের ব্যবস্থা করি। আমার অবস্থায় থাকলে এইগুলা করতে হয়। বুঝতে পারতেছ?
আনিস জবাব দিল না। চুপ করে রইল। তার বাসায় ফেরা উচিত। সকিনার খবর নিয়ে অতি দ্রুত নবনীর কাছে যাওয়া উচিত। কে জানে নবনীর জ্বর হয়তো আরো বেড়েছে। বড় মানুষদের কনফেসন শোনা তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। তবে এই কনফেসনটা প্ৰায় সময়ই ওষুধের মতো কাজ করে। সেই অর্থে জহির খাঁর কথা তার শোনা উচিত।