হ্যাঁ যাব।
যে নিতে এসেছে তার নাম কী?
তার নাম বদি।
বাহ সুন্দর নাম তো। বন্দ থেকে বদি। ভালো থেকে ভালি। আচ্ছা ভালি নামে কেউ কি তোমাদের এই বিরাটনগরে আছে?
জানি না।
একটু খোঁজ নিয়ে দেখ তো।
আচ্ছা খোঁজ নেব। তুমি ঘুমুবার চেষ্টা কর।
আমাকে ঘুম পাড়াবার জন্যে তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। তুমি বদির সঙ্গে যেখানে যেতে চাও–যেতে পার। এই যে তুমি আমাকে ফেলে ফেলে চলে যাচ্ছ এতে কিন্তু আমার খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। কেন ভালো লাগছে বলব?
বল।
নবনী আগ্রহের সঙ্গে বলল, আমার এই কারণে ভালো লাগছে যে তোমারও আমার প্রতি আগ্রহ কম। যদি সে-রকম আগ্রহ সেরকম মমতা থাকত–আমাকে ফেলে যেতে পারতে না। আমি নিজেও খুবই অসুস্থ। মাথায় আর পানি দিও না। ভালো লাগছে না। শুকনো তোয়ালে দিয়ে মাথাটা মুছিয়ে দাও।
আনিস মাথা মুছিয়ে দিল। নবনী বলল, এখন তুমি যেখানে যেতে চাও চলে যাও। কাল ভোরের ট্রেনে আমাকে তুলে দেবে। জ্বর কমুক বা না কমুক আমি চলে যাব।
আচ্ছা।
তুমি আমার সঙ্গে যাবে না। আমি যেমন একা এসেছি–একাই যাব।
আচ্ছা।
আমি দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমি আর দুঃস্বপ্ন দেখতে চাই না। বুঝতে পারছি আমি কী বলার চেষ্টা করছি?
তোমার শরীর ভালো না। তুমি কি বলছি নিজেও জান না।
আমি কী বলছি তা খুব ভালো করে জানি।
আনিস ক্লান্ত স্বরে বলল, তুমি যা চাইবে তাই হবে।
নবনী বলল, থ্যাংক য়ু। এখন যাও, বদি বলে যে এসেছে তার সঙ্গে যাও। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকব।
নবনী চোখ বন্ধ করল।
পুরো গ্রাম জুড়েই উত্তেজনা।
প্রতিটি বাড়িতেই বাতি জ্বলছে। আজিজ মিয়ার বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকজন আসতে শুরু করেছে। মানুষের উত্তেজনা পশুপাখিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। কুকুর ডাকছে। মাঝে মাঝে কাক ডাকছে। কুকুর এবং কাক মানুষের খুব কাছাকাছি বাস করে। এরা মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে চায়।
গ্রামের সব মানুষ জেগে থাকলেও রাস্তা ঘাট ফাঁকা। আনিস সাইকেল বের করেছে। অনেকদিন সাইকেলে চড়া হয় না। তার ইচ্ছা চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে প্ৰথমেই যাবে। ঘটনা। কী জেনে ফেরার পথে ইমাম সাহেবের বাড়িতে যাবে। সকিনা মেয়েটি সেখানে একা বাস করছে। সে নিশ্চয়ই খুব ভয় পাচ্ছে। মেয়েটাকে বলবে তার বাড়িতে চলে আসতে। নবনী কাল চলে যাবে। সেও চলে যাক নবনীর সঙ্গে। তার এখানে একা থাকা ঠিক না। আনিসের শ্মশানঘাটে যেতেও খুব ইচ্ছা করছে। নবনীর আসার পর থেকে শ্মশানঘাটে যাওয়া হয় নি। অন্ধকার রাতে শ্বেতপাথরের মেঝেতে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকা। আকাশের তারা দেখা।
আনিসের ধারণা নবনী খুব ভুল চিন্তা করে নি। তাদের দু’জনের সম্পর্ক জমাট বাঁধে নি। সম্পর্কের রসায়নে খুব সূক্ষ্ম কোনো সমস্যা হয়েছে–সম্পর্ক জমাট বাঁধতে পারছে না। সম্পর্ক যে জমাট বাধে নি তার সবচে বড় প্রমাণ শ্মশানঘাটে নবনীকে তার নিয়ে যেতে ইচ্ছা করে নি। এই জায়গাটা যেন শুধুই তার একার। সেখানে অন্য কেউ যাবে না।
নবনীর সঙ্গে তার বিয়েটা প্রেমের বিয়ে এটা বলা যাবে না। দুজনের পরিচয় খুবই আকস্মিক। নীলক্ষেতে পুরনো বইয়ের দোকানে আনিস বই ঘাটছিল। এই দোকানগুলিতে হঠাৎ হঠাৎ কিছু ভালো বই পাওয়া যায়। Psychology of Dying Cancer Patients নামের অসাধারণ একটা বই মাত্র চল্লিশ টাকায় এখান থেকেই আনিস কিনেছিল। ধর্মগ্রন্থ মানুষ যেভাবে পাঠ করে, এই বই আনিস সেভাবেই পাঠ করে।
আনিস নিজের মনে বই ঘাঁটছে তখন একজন কে যেন আনিসের পাশে এসে বলল, আপা আপনাকে একটু ডাকে। আনিস তাকিয়ে দেখল–একটু দূরে গাড়ি পার্ক করা। গাড়িতে অতি রূপবতী এক তরুণী বসে আছে। আনিস তরুণীকে চিনতে পারল না। আনিস বলল, আপনার ভুল হয়েছে। আমাকে না, উনি হয়তো অন্য কাউকে ডাকছেন—।
লোকটি বলল, আপনাকেই ডাকেন। আপনার নাম আনিস না?
আনিস বলল, হ্যাঁ আমার নাম আনিস।
বই ঘাটা বন্ধ করে আনিস এগিয়ে গেল। তরুণী মেয়েটি বলল, আপনার নাম আনিস না?
আনিস বলল, হ্যাঁ।
আপনারা ছোটবেলায় কখনো কুমিল্লায় ছিলেন?
ছিলাম।
আপনার ছোটবোন মিনুর সঙ্গে আমি পড়তাম।
মিনু নামে আমার কোনো ছোটবোন নেই।
মিনু নানার বাড়িতে গিয়ে পুকুরে ড়ুবে মারা গিয়েছিল। আপনাদের নানার বাড়ি ময়মনসিংহে।
আনিস খুবই বিনয়ের সঙ্গে বলল, কোনো এক জায়গায় আপনার ভুল হচ্ছে। আমার নাম আনিস ঠিক আছে। কুমিল্লায় ছোটবেলায় ছিলাম তাও ঠিক আছে। আমাদের নানার বাড়ি যে ময়মনসিংহ তাও ঠিক–কিন্তু আমি সেই মানুষ না।
আপনার বাবা কানাডায় থাকতেন। মিনুর মৃত্যুর পর তিনি সবাইকে নিয়ে কানাডা চলে যান।
আনিস হতাশ গলায় বলল, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না। আমি বরং একটা কাজ করি–আমার বাবা-মা কলাবাগানে থাকেন। আমি একটা কাগজে ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। তাদের সঙ্গে কথা বললেই আপনার কনফিউসন দূর হবে।
তরুণী শক্ত গলায় বলল, ঠিকানা টেলিফোন নাম্বার সবই লিখে দিন। আমি আজই যাব। এখনি যাব। এক কাজ করুন–ঠিকানা লেখার দরকার নেই। আমি অপেক্ষা করছি। আপনি বই ঘাটছিলেন বই ঘাটা শেষ করে গাড়িতে উঠুন। আপনাকে নিয়েই আমি যাব।
আনিস বলল, আপনার কি সন্দেহ আমি আপনাকে ভুল ঠিকানা দেব?
এরকম সন্দেহ যে আমার হচ্ছে না, তা-না।
আনিসের বাড়িতে গিয়ে তরুণী মেয়েটির সন্দেহ দূর হয়েছিল। তারপরেও সে অনেকক্ষণ সে বাড়িতে রইল। খাটে পা তুলে নিতান্ত পরিচিতজনের মতো বসে গল্প করতে লাগল। আনিসের মা যখন বললেন, মা আজ দুপুরে তুমি আমাদের সঙ্গে খাও–নবনী তৎক্ষণাৎ বলল, আচ্ছা। এক পর্যায়ে আনিসের বাবা এসে ইশারায় তাকে ডেকে পাশের কামরায় নিয়ে গলা নিচু করে বললেন, মা তুমি ঐ মহিলাকে বল সে যেন এ রকম শব্দ করে না হাসে। আমার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। জরুরি একটা কাজ করছি এর মধ্যে বাড়ি ঘর কাঁপিয়ে হেহেহে। মেয়েদের হাসির মধ্যে একটা সৌন্দর্য থাকবে, মাধুর্য থাকবে। তার কিছুই নেই। হাসি শুনলে মনে হবে কয়েকটা হায়না। ঝগড়া করছে। এ ওকে কামড়াচ্ছে।