নবনীর জ্বর খুব বেড়েছে। তার চোখ রক্তবর্ণ। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আনিস নবনীর মাথায় পানি ঢালছে। দরজার ওপাশ থেকে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে সুজাত মিয়া। নবনীর এই অসুখের জন্য সে নিজেকে দায়ী করছে। সে তাকে অনেক ভালো বুদ্ধি গ্রামদেশে আছে। জিনের ফকিরকে আনলেই সে ব্যবস্থা করবে। এই কথা ডাক্তার সাহেবকে বলার সাহস তার নেই। সে জানে ডাক্তার সাহেবও কঠিন লোক। পীর ফকিরের যে ক্ষমতা আছে, এই লোকেরও সেই ক্ষমতা আছে। সাপের ওঝা সাপের বিষ নামাতে পারে। ডাক্তার সাহেব ওঝা না হয়েও সাপের বিষ নামায়। তার সাইকেল চুরি করেও চোর সুবিধা করতে পারে নি। সাইকেল ফেরত দিয়ে যেতে হয়েছে। ডাক্তার সাহেব এক ধরনের সাধনাও করেন। শ্মশানঘাটে একা বসে থাকেন। তার জিন সাধনা থাকাও বিচিত্র না। জিনের চেয়েও বড় সাধনা আছে। পরী সাধনা। সেই সাধনাও থাকতে পারে। তারপরেও সুজাত মিয়ার ভয় লাগছে। কারণ বিরাটনগরের অবস্থা ভালো না। ইমাম সাহেব বড় ত্যক্ত করছে। কোরান হাদিস জানা লোক যখন অপঘাতে মরে তখন তাদের অনেক ক্ষমতা হয়। তার নমুনা দেখা যাচ্ছে–আজিজ মিয়াকে পানিতে ড়ুবিয়ে মেরে ফেলল। তাকে যখন পানি থেকে তোলা হলো তখনও সামান্য জ্ঞান ছিল। কয়েকবার শুধু বলল, ইমাম সাব কই? ইমাম সাব? তারপরই সব শেষ। জীবন থাকতে থাকতে ডাক্তার সাবকে খবর দিয়ে নিলে ডাক্তার সােব তাকে বাঁচিয়ে ফেলতেন। খবরটা আসছে মৃত্যুর পরে। দুনিয়ার লোক ভিড় করেছে আজিজ মিয়ার বাড়িতে। সুজাতেরও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। ভয়ের কারণে যায় নাই। ইমাম সাহেব আশেপাশেই আছে। কী দরকার।
আনিস সুজাতের দিকে তাকিয়ে বলল, জেগে থাকার দরকার নেই, তুমি শুয়ে পড়ে।
সুজাত দরজার আড়াল থেকে সরে গেল। কিন্তু শুয়ে পড়ল না। আজকের রাতটা ভালো না। ভয়ঙ্কর রাত। এই রাতে জেগে থাকা দরকার। আরো কত কী ঘটতে পারে। সুজাতের ধারণা চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতেও কোনো একটা ঘটনা ঘটছে। কারণ এক ঘণ্টার ওপর হয়েছে। বদি এসে বসে আছে। ডাক্তার সাহেবকে নিয়ে যেতে হবে চেয়ারম্যান সাহেব খবর পাঠিয়েছেন। সুজাতের ধারণা ডাক্তার সাহেব যাবেন না। চেয়ারম্যান সাহেবে পাইক বীরকন্দাজ পাঠালেও যাবেন না। কারণ ডাক্তার সাহেবের স্ত্রীর অবস্থাও ভালো না। এমন একটা ভয়ঙ্কর রাতে স্ত্রীকে একা ফেলে ডাক্তার সাহেব যাবে না।
নবনী ক্ষীণ স্বরে বলল, একটু পানি খাওয়াও তো।
আনিস গ্লাসে করে পানি দিল। নবনী পানিতে একটা চুমুক দিয়ে গ্লাস ফিরিয়ে দিল। পানি তিতা লাগছে। নবনী বলল, আমার জ্বর কি কিছু কমেছে?
আনিস বলল, না। তা হলে কি সামান্য বেড়েছে? হ্যাঁ একশ তিন ছিল। এখন হয়েছে একশ তিন পয়েন্ট পাঁচ। তবে মাথায় পানি ঢালছি। এনালজেসিক খাওয়ানো হয়েছে। জ্বর নেমে যাবে।
নবনী হালকা স্বরে বলল, তুমি অন্যদের চেয়ে আলাদা। আমি যখন বললাম জ্বর কি কমেছে তখনও অন্য যে-কোনো ডাক্তার হলে বলত হ্যাঁ সামান্য কমেছে। তুমি সত্যি কথাটা বললে। তবে আমার ধারণা মাঝে মাঝে মিথ্যা বলাটা অপরাধ না।
কথা না বলে ঘুমুবার চেষ্টা কর।
আমার কথা বলতে ভালো লাগছে।
তাহলে বল।
আমি স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের ব্যাপারটা নিয়ে খুব চিন্তিত।
এত চিন্তিত হবার কী আছে?
নবনী বলল, আমি ঘর পোড়া গরু তো এই জন্যেই চিন্তিত। আমি আবার বাবা-মা’কে দেখেছি।
আনিস বলল, তোমার কাছেই শুনেছি তাদের সম্পর্ক ভালো ছিল।
বাইরে বাইরে ছিল। ভেতরে ছিল না। তেলে জলে কখনো মিশ খায় নি। তুমি তো জান না আমার মা একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে মারা যান। ঘটনাটা আমরা চাপা দিয়ে রেখেছি। প্রায় কেউই এই ঘটনা জানে না। জ্বরের ঘোরে তোমাকে বললাম।
তোমার মা যখন মারা যান। তখন তোমার বয়স কত ছিল?
পনের বছর, আমি তখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি।
আমি যেমন দুঃস্বপ্ন দেখি আমার মাও সে রকম দুঃস্বপ্ন দেখতেন।
আনিস চুপ করে আছে। সে সামান্য চিন্তিত–জ্বর একেবারেই নামছে না। নবনী চাপা গলায় বলল, বাবা মাকে দেখে আমি কখনো বুঝতেই পারি নি তাদের সম্পর্কটা এতটা নষ্ট হয়েছে। কাজেই আমি ভয় পাই। আমি খুবই ভয় পাই। –
আনিস বলল, কিছু কিছু মানুষ আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে জন্মায়। স্বামী এবং স্ত্রীর ভেতর খুব ভালো সম্পর্ক, তারপরেও দেখা যায়। এদের একজন কেউ কাণ্ডটা করে ফেলেছে। এটা এক ধরনের অসুস্থতা।
নবনী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যে অসুস্থতা আমার মায়ের মধ্যে আছে, সেই অসুখ তো আমার মধ্যেও থাকতে পারে। থাকতে পারে না? মা’র জিন কি আমার মধ্যে নেই? তোমাদের ডাক্তারি শাস্ত্র কী বলে?
আনিস জবাব দিল না। নবনী বলল, তোমার এখানে এসে আমার সামান্য মন খারাপ হয়েছে। কেন জান?
না, জানি না।
আমি দেখলাম আমি তোমাকে যে সব চিঠি লিখেছি তার সবই তুমি খুব যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে–অথচ তোমার চিঠিগুলো আমার কাছে নেই। চিঠি পড়া হয়ে গেছে, আমি ভুলে গেছি। এতে কি প্রমাণিত হয় তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কম?
এতে কিছুই প্রমাণিত হয় না।
হ্যাঁ প্রমাণিত হয়। আবার দেখ আমি জ্বরে ছটফট করছি–এই অবস্থায় আজিজ মিয়া নামে একজনের বাড়ি থেকে তোমাকে নিতে এল তুমি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফেলে চলে গেলে। এখন আবার আরেকজন কে এসেছে, তোমাকে কোথায় যেন নিতে চায়। আমার অবস্থা যত খারাপই হোক তুমি কিন্তু ঐ লোকের সঙ্গে যাবে। যাবে না?