আজিজ মিয়া অবাক হয়ে দেখল। সবাই তাদের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। একজন আড়ং-এর ষাঁড়কে ভুষি দিচ্ছে। আরেকজন ষাড়ের গোসলের ব্যবস্থা করছে। হাইস্কুলের হেডমাস্টার সাহেব চাদার খাতা নিয়ে এসেছেন। স্কুলে চাঁদা দিতে হবে। হেডমাস্টার সাহেবকে বিসকিট দিয়ে চা দেয়া হয়েছে। তিনি চায়ে বিসকিট ড়ুবিয়ে খাচ্ছেন। অথচ উঠানে কফিনটা পড়ে আছে, কেউ কফিন খোলার কথা বলছে না।
আজিজ মিয়া নিজেই কফিন খুলতে এগিয়ে গেল। সেখানে দেখা গোল ইমাম সাহেবকে। স্বপ্নের মধ্যেই আজিজ মিয়া বুঝতে পারছে ইমাম সাহেব জীবিত না। তিনি তেতুল গাছে ফাঁস নিয়ে মারা গেছেন। আজিজ মিয়াকে দেখে ইমাম সাহেব বললেন, আপনি করেন কী! কফিন খুলতেছেন কেন? যে রকম আছে সে রকম থাকুক।
স্বপ্নের মধ্যেই আজিজ মিয়া রাগী গলায় বলল, আমার ছেলেকে আমি দেখব না?
ইমাম সাহেব বললেন, না দেখবেন না। দেখলে কষ্ট পাবেন। আপনার ছেলে ফাঁস নিয়ে মরেছে। লাশ বিকৃত হয়ে গেছে। এই লাশ কাউকে দেখানোর দরকার নাই। আসুন চুপিচুপি কবর দিয়ে ফেলি।
আজিজ মিয়া আর্তনাদ করে বলল, আমার ছেলের জানাজা হবে না?
ইমাম সাহেব বললেন, না। আমার যেমন জানাজা হয় নাই, আপনার ছেলেরও হবে না। ফাঁসের মরার জানাজা হয় না। আসুন কেউ কিছু টের পাওয়ার আগেই গর্ত খুঁড়ে কফিন মাটির নিচে ঢুকিয়ে ফেলি।
তারপরই স্বপ্নের পট পরিবর্তন হলো। দেখা গেল মসজিদের পাশে তেতুল গাছের নিচে আজিজ মিয়া এবং ইমাম সাহেব কোদাল দিয়ে গর্ত করা শুরু করেছেন। শুধুই তারা দুইজন। আশেপাশে কেউ নেই। কোনো শব্দ নেই। শুধু কোদাল দিয়ে মাটি কাটার ধুপ ধুপ শব্দ হচ্ছে।
আজিজ মিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পরও সে কোদালের ধুপ ধুপ শব্দ শুনতে পাচ্ছে। এই শব্দ যে তার হৃৎপিণ্ডের লাফানোর শব্দ তা বুঝতেও তার সময় লাগল। বুকের মধ্যে শব্দ এত জোরে হচ্ছে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি দূরে কোথাও কোদাল দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে–ধুপ ধুপ। ধুপ ধুপ।
চারদিক গাঢ় অন্ধকার। বাতাস। শীতল। কোনো শব্দ নেই। বিঝি পোকাও ডাকছে না। শুধু দূরে কোদাল দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। আজিজ মিয়া হঠাৎ দৌড়াতে শুরু করল। তার মনেই রইল না, সে এখন একা চলা ফেরা করে না। তার পা খালি। জুতা-স্যান্ডল কিছুই নেই। এখন তার একটাই চিন্তা–কত তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌছানো যায়। সে দেখতে চায় তার বাড়ির উঠানে কোনো কফিন নেই।
অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়েছে। নক্ষত্রের আলোয় সব কিছুই আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। বাজার থেকে আজিজ মিয়ার বাড়িতে যাবার দুটা রাস্তা আছে। একটা মসজিদের পাশ দিয়ে, অন্যটা ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক দিয়ে। দ্রুত আসা যাবে মসজিদের পাশ দিয়েই। আজিজ মিয়া সেই পথ ধরল। যদিও এই পথে এখন লোক চলাচল করে না। ভয় পায়। আজিজ মিয়া এখন যাবতীয় ভয়ের উর্ধে। তাকে যে ভয় তাড়া করছে সে ভয়ের কাছে আর সব ভয় তুচ্ছ।
মসজিদ পার হয়েই আজিজ মিয়া থমকে দাঁড়াল। সড়কের ঠিক মাঝখানে কে যেন বসে আছে। ইমাম সাহেব না? হ্যাঁ ইমামই তো–ইয়াকুব মোল্লা। সে তো মারা গেছে। তার কবর হয়েছে। সে এখানে রাস্তার মাঝখানে বসে আছে। কেন? আজিজ মিয়া চিৎকার করে বলল, কে কে? কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হলো না। আজিজ মিয়া পেছনে ফিরল। পেছনেও একজন দাঁড়িয়ে আছে। কে সে? নক্ষত্রের অস্পষ্ট আলোয় কিছুই পরিষ্কার দেখা যায় না। কিন্তু পেছনে যে দাঁড়িয়ে আছে সেও যে ইমাম সাহেব তা বুঝা যাচ্ছে। পেছনের ইমাম সাহেবের হাতে লম্বা ছুরি। কোরবানির সময় ইমাম সাহেব এরকম একটা ছুরি নিয়েই গরু জবাই করতে বের হতেন। আজিজ মিয়ার শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে রাস্তার মাঝখানেই সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। এটা করা যাবে না। তাকে পালাতে হবে। চিৎকার করে লাভ নেই, গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। তাকে পালাতে হবে। কোন দিকে সে পালাবে?
আজিজ মিয়া রাস্তা থেকে নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াতে শুরু করল। ইমাম সাহেবও তার পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে। একজন ইমাম না, দু’জন। একজনের হাতে ছুরি, আরেকজনের হাতে কিছু নেই। আজিজ মিয়া জানত ঘটনা শেষ পর্যন্ত এরকম ঘটবে। কারণ সে ইমাম সাহেবকে কানে ধরে স্কুলের মাঠে চক্কর দিয়েছে। এর শাস্তি ইমাম সাহেব তাকে দেবেনই।
বুকে হাঁপ ধরে গেছে। আজিজ মিয়া ঠিকমতো দৌড়াতে পারছে না। আজিজ মিয়া দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ফিরে দেখল। ইমাম সাহেবও দাঁড়িয়ে আছেন। এখন ইমাম একজন না। তিনজন। শুধু একজনের হাতে ছুরি। অন্য দু’জনের হাত খালি। আজিজ মিয়া আবার দৌড়াতে শুরু করল। সে কোন দিকে যাচ্ছে নিজেও জানে না। একবার মনে হলো সে একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে, একবার মনে হচ্ছে সে আসলে দৌড়াচ্ছে না, বাতাসে উড়ছে। সামনে এটা কী? পুকুর না? আজিজ মিয়া ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে পড়ল। পুকুরের পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা। হা–পা জমে যাচ্ছে। আজিজ মিয়া খুব ভালো সাঁতার জানে। কিন্তু সে সাঁতার দিতে পারছে না। পানিতে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। পুকুর পাড়ে তিন ইমাম দাঁড়িয়ে আছে। পুকুরের পানিতে তাদের ছায়া পড়েছে। ছায়া পড়ার কথা না। নক্ষত্রের আলোয় কোনো কিছুরই ছায়া পড়ে না। আজিজ মিয়া ক্ষীণ স্বরে ডাকিল, ও বকুলের মা! ও বকুলের মা।
বকুল আজিজ মিয়ার ছেলের নাম। বকুলের মা জবাব দিল না। তখন আজিজ মিয়া ডাকতে শুরু করল তার মা’কে। ও মাইজী। ও মাইজী।