নবনী ক্লান্ত গলায় বলল, আমি অন্ধকারে কথা বলতে পারি না। কথা বলতে হলে–আমার মুখ দেখতে হয়। কাজেই আজ বাদ থাক।
আনিস বলল, আচ্ছা বাদ থাক। সঙ্গে সঙ্গে নবনী খাটের ওপর উঠে বসে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। আমি বলছি। তুমি শুনে খুবই মনে কষ্ট পাবে, তারপরেও বলছি–তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটা ওয়ার্ক আউট করছে না। মানুষ হিসেবে তুমি খুব ভালো, মেয়ে হিসেবে আমিও ভালো। তারপরেও না। আমাদের বিয়েটা ফেল করেছে।
আনিস সহজ গলায় বলল, এখনো তো সময় আছে।
নবনী বলল, সময় তো আছেই। জোড়াতালি দিয়ে আমরা হয়তো এগিয়ে যাব। আমি জোড়াতালি ব্যাপারটা পছন্দ করি না।
আনিস বলল, তোমার শরীর ভালো না। জ্বর অনেক বেড়েছে। জটিল একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করার মতো অবস্থা তোমার না। আমরা পরে আলাপ করি।
নবনী বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, আমার কথা যা বলার বলে ফেলেছি। আমার আর কিছু বলার নেই।
জহির খাঁ খেতে বসেছেন। একটু দূরে বসেছে ছগীর। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ভালো। গ্রামের দাওয়াতে পোলাও কোরমা থাকেই–তার পরে আছে ক্লাই মাছ ভাজা। একেকটা টুকরা প্লেটে ধরে না। এত বড়! মাছের মাথাটা ছগীরকে দেওয়া হয়েছে। সে কিছুক্ষণ পর পর তৃপ্তি নিয়ে মাছের মাথাটার দিকে তাকাচ্ছে। জহির খাঁ বললেন, পাক কেমন হয়েছে?
ছগীরের মুখ ভর্তি মাছ। সে অনেক কষ্টে বলল, বেহেশতী খানা হইছে চেয়ারম্যান সাব। দাওয়াতী মেহমান এই খানা খাইতে পারল না, এটা একটা আফসোস।
আফসোস করার কিছু নাই। আইজ আসতে পারে নাই, আরেকদিন আসব। সুবিধা অসুবিধা সবেরই আছে।
শুনেছি ডাক্তার সাবের ইস্ত্রীরে জিনে ধরেছে। সারা দিন আউল চুলে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছে। সুযোগ বুইজ্যা ধরছে জিনে।
শোনা কথায় কান দিও না। কানের ওপরে বিশ্বাস নাই, কান নিমকহারাম। অতি খাঁটি কথা বলেছেন চেয়ারম্যান সাব। তরকারিতে লবণ কি একটু কম হয়েছে?
একদানা লবণ কম হয় নাই, আবার একদানা লবণ বেশিও হয় নাই। জবরদস্ত হইছে।
খাও, আরাম কইরা খাও। মাথাটা ভাইঙ্গা মুখে দেও।
ছগীর আগ্রহের সঙ্গে মাথা ভাঙ্গল।
আনন্দে তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সে অতি সাধারণ একজন। রেলে রেলে ম্যাজিক দেখায়। দড়ি কাটার ম্যাজিক, পয়সার ম্যাজিক, তাসের ম্যাজিক। সস্তার জিনিস। তারপরেও চেয়ারম্যান সাহেবের মতো মানী লোকের কাছে তার ডাক পড়ে। এটা ভাগ্য ছাড়া আর কী? তাকে অবহেলাও করা হচ্ছে না। উঠানে কলাপাতায় খাবার দেওয়া হচ্ছে না। চিনামাটির বাসনেই সে খাচ্ছে। চলে যাবার সময় চেয়্যারম্যান সাহেব দশ টাকা বখশিশও তাকে দেবেন।
মতি নান্দাইল রোড থেকে অনেক রাতে ফিরছে। তার হাতে হারিকেন। হারিকেনের সবচে’ বড় অসুবিধা হলো–দূরের কিছু দেখা যায় না। গ্রামে পথ চলার জন্যে হারিকেন কাজের কিছু না। অন্ধকারে পথ চলতে লাগে টর্চ। মতির টর্চের ভাগ্য খুব খারাপ। টর্চ কেনার সাতদিনের মাথায় সে হারাবেই।
ডাক্তার সাহেবের সাইকেল বেচা টাকায় টর্চ কিনতে গিয়েও সে কেনে নি। কী হবে কিনো! দুদিন পরে তো হারিয়েই যাবে। এখন মনে হচ্ছে টর্চ না কেনোটা খুবই বোকামি হয়েছে। গ্রামে নানান উপদ্রব শুরু হয়েছে। চোর-ডাকাতের চেয়েও হাজার গুণে ভয়ঙ্কর কিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই সময় টর্চ ছাড়া গ্রামে আসাই ঠিক না। একটা টর্চ, একটা হারিকেন। টর্চ দরকার দূরের জিনিস দেখার জন্যে। হারিকেন দরকার জ্বলন্ত আগুনের জন্যে। নিশিরাতে মানুষের শরীর ধারণ করে যারা চলাফেরা করে, তারা একটা জিনিশই ভয় পায়। সেই জিনিশের নাম—আগুন।
জুম্মাঘরের কাছাকাছি এসে মতি বিড়ি ধরাল। জিন-ভূত বিড়ির আগুনকেও ভয় পায়। বাতাসের হঠাৎ ঝাপ্টায় হাতের হারিকেন নিভে যেতে পারে। বিড়ির আগুন নিভবে না। সবচে’ ভালো ছিল আয়াতুল কুরাসির তাবিজ। গলায় একটা তাবিজ পরা থাকলে দশ হাতের ভেতর জিন, ভূত, খারাপ বাতাস কিছুই আসতে পারে না। এই তাবিজের বড় সমস্যা হলো—তাবিজ গলায় নিয়ে নাপাক অবস্থায় থাকা যায় না। আজে বাজে জায়গায় যাওয়া যায় না।
মতি থমকে দাঁড়াল। ইমাম সাহেবের বাড়ির উঠানে কে যেন হাঁটাহাঁটি করছে! হারিকেনের আলো উঠানে পর্যন্ত যাচ্ছে না। তারপরেও মতি নিশ্চিতএকজন কেউ হাঁটাইটি করছে। তার গায়ে কালো আচকান। মতির শরীর ঘেমে গেল। তার সমস্ত মন চাচ্ছে–হারিকেন ফেলে উল্টো দিকে দৌড় দিতে–কিন্তু হাত পা জমে গেছে। সে বুঝতেই পারল না, কখন তার হাত থেকে হারিকেন পড়ে গেছে। সে বিকৃত গলায় বলল, কে কে? উঠানে কে?
মতি অবাক হয়ে দেখল উঠানের মানুষটা তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে আবারো ভাঙা গলায় বলল, কে কে?
মানুষটা থমকে দাঁড়াল। স্পষ্ট গলায় বলল, আপনি ভয় পাবেন না। আমি জিন ভূত না। আমার নাম সকিনা। আমি ইমাম সাহেবের মেয়ে।
পায়ের কাছে পড়ে থাকা হারিকেন নিভে যায় নি। দপদপ করে জ্বলছে। প্রচুর ধোঁয়া বের হচ্ছে। মতি হারিকেন তুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কালো চাদর গায়ে জড়িয়ে যে মেয়েটা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে–এত রূপবতী মেয়ে সে তার জীবনে কখনো দেখে নি। বেহেশতের পর এই মেয়ের কাছে কিছু না। বেহেশতের যে-কোনো হুরকে এই মেয়ে দাসী হিসাবে বিনা বেতনে তার কাছে রেখে দিতে পারে।
আজিজ মিয়া ঘুমুচ্ছিল
রাত একটা।
আজিজ মিয়া ঘুমুচ্ছিল বাজারের ঘরে। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে তাঁর ঘুম ভাঙল। দুঃস্বপ্নটা এতই স্পষ্ট যে মনে হচ্ছিল। ঘটনাটা সত্যিই ঘটেছে। সে দেখল তার বাড়িতে একটা কফিন এসেছে। কফিন সে আগে কখনো দেখে নি। কিন্তু স্বপ্নে দেখামাত্র সে কফিনটা চিনতে পারল। বুঝতে পারল এই বাক্স করে মৃত ছেলে এসেছে। অথচ এই ভয়ঙ্কর ব্যাপার নিয়ে কারো মনেই কোনো টেনশান নেই। আজিজ মিয়ার স্ত্রী হাফিজা যথারীতি জর্দা দিয়ে পান খাচ্ছে। পানের পিক ফেলে কাকে যেন বলল, আমার মাথায় তেল দিয়ে দে। কে একজন তার মাথায় তেল দিতে বসল।