জ্বে আচ্ছা।
নয়াপাড়া থাইক্যা ছগীররে খবর দিয়া আনিবা। জাদু দেখাইব। শহরের মেয়ে গেরাইম্যা জাদু তো দেখে নাই। দেখলে খুশি হইব।
জ্বে আইচ্ছা।
তোমার শ্লোকটা কী আরেকবার বল দেখি–
নৌকা নহে জলে চলে শূন্যতেও চলে
দিনেতে দেখি না তারে দেখি নিশাকালে।
জহির খাঁ চিন্তিত গলায় বললেন–জলেও চলে, শূন্যতেও চলে—বল কী?
বদি হাসিমুখে বলল, জিনিসটা হইল…
জিনিস কী তোমার বলার প্রয়োজন নাই। আমি বাইর করতেছি।
জহির খাঁ গভীর চিন্তায় ড়ুবে গেলেন।
চৈত্র মাসের রোদে তালু ফাটে। কিন্তু এই রোদ তালু ভেদ করে মগজে ঢুকতে পারে না। আশ্বিন মাসের রোদ আবার অন্য রকম–এই রোদ তালু ভেদ করে মগজে ঢুকে যায়। মগজ ওলট-পালট করে দেয়।
ছাতা থাকা সত্ত্বেও নবনী আশ্বিন মাসের রোদ পুরোটা মাথায় নিয়েছে। রেল সড়ক থেকে ফেরার পথে মাথায় ছাতা দেয় নি। গায়ে রোদ লাগাতে তার নাকি ভালো লাগছে। সেই ভালো লাগা এখন উল্টো গীত গাইতে শুরু করেছে। বাড়িতে ফিরেই নবনী বমি করল। আনিস অবাক হয়ে বলল, ব্যাপার কী?
নবনী বলল, ব্যাপার বুঝতে পারছি না? বমি করছি এই হলো ব্যাপার। তুমি ডাক্তার মানুষ। তুমি কি আমার আগে কাউকে বমি করতে দেখ নি?
জহির বলল, কী হয়েছে?
শরীর যেন কেমন করছে। তোমাকে অস্থির হতে হবে না। লম্বা গোসল দেব। শরীর সেরে যাবে।
আনিস বলল, দেখি তো জ্বর এসেছে কি-না। জ্বর দেখতে হবে না। তুমি দয়া করে সামনে থেকে যাও–কটকটা রঙের কী পাঞ্জাবি পরেছ–চোখে লাগছে।
কোথায় গিয়েছিলে?
রেল সড়ক দেখতে গিয়েছিলাম।
বল কী? অনেক দূর তো! হেঁটে গিয়েছ?
নবনী বলল, না হেঁটে কেন যাব, হেলিকপ্টার চার্টার করে গিয়েছি। তোমার তদন্ত যদি শেষ হয়ে থাকে তাহলে সামনে থেকে যাও। তোমার শার্টের দিকে যতবার তাকাচ্ছি, ততবার শরীর বিমঝিম করে উঠছে।
আনিস বলল, তোমার সামনে থেকে যেতে চাচ্ছি না। শার্টটা বরং বদলে আসি।
নবনী ক্লান্ত গলায় বলল, যাও বদলে আস।। হালকা রঙের কিছু পরবে। সবচে’ ভালো হয় সাদা।
নবনী এক ঘণ্টা সময় লাগিয়ে গোসল করল। গোসল শেষ করে বিছানায় পড়ে গেল। তার গায়ের তাপ এক শ’ তিনের চেয়েও সামান্য বেশি। আনিস বলল, খুব খারাপ লাগছে?
নবনী বলল, খুব খারাপ না। মোটামুটি খারাপ লাগছে।
বমি ভাবটা কি গেছে না এখনো আছে?
এখনো আছে।
তাহলে কিছু খাবার দরকার নেই। শুয়ে থাক। ওষুধ দিচ্ছি, এক্ষনি জ্বর কমে যাবে।
নবনী বলল, ওষুধ দিয়ে এই জ্বর নামাতে পারবে না। এই জ্বর খুব বাড়বে। সারা রাত ছটফট করব। শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়ব, তখন জ্বর থেমে যাবে।
কীভাবে বলছে?
আমার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে। ইএসপি পাওয়ার। সেই ক্ষমতা থেকে বলছি।
তোমার ক্ষমতার ব্যাপারটা মানলাম। তারপরেও ওষুধ দিচ্ছি, খাও।
নবনী তরল গলায় বলল, যে ওষুধে কাজ করবে না। সেই ওষুধ খেয়ে লাভ কী? ওষুধ খাব না।
ছেলেমানুষি করো না তো।
আমি ছেলেমানুষিা করছি না। ওষুধ আমি খাব না।
আচ্ছা ঠিক আছে ওষুধ খেতে হবে না। দেখি জ্বরটা আরেকবার দেখি।
নবনী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জ্বর আরো খানিকটা বেড়েছে। এখন আমার জ্বর এক শ’ চার।
এটাও কি ইএসপি ক্ষমতা ব্যবহার করে বলছ?
হ্যাঁ।
জ্বর দেখতে পারব না?
না।
পাশে তো বসে থাকতে পারি। না-কি সেটাও পারব না? কটকটে রঙের শাটটা বদলে সাদা পাঞ্জাবি পরেছি। এখন নিশ্চয়ই চোখে লাগছে না।
নবনী বলল, খাটে না বসে চেয়ারটায় বোস। জ্বর যখন বেশি হয় তখন চোখে আপনাআপনি একটা জুম এফেক্ট তৈরি হয়। সব কিছু চোখের কাছাকাছি চলে আসে। তুমি যদি খাটে বস–আমার কাছে মনে হবে তুমি চোখের ওপর বসে আছ।
আনিস চেয়ারে বসল। সে চিন্তিত বোধ করছে। জ্বর যে বাড়ছে এটা বুঝা যাচ্ছে। রোগী ডিলেরিয়ামে চলে যাচ্ছে। তার লক্ষণ স্পষ্ট। চোখের তারা ডাইলেটেড হয়েছে। অর্থহীন কথাবার্তা বলা শুরু হয়েছে।
নবনী আনিসের দিকে ফিরল। ক্লান্ত গলায় বলল, আমি চাচ্ছি জ্বরটা আরেকটু বাড়ুক।
আনিস বলল, কেন?
আমি খুব জরুরি কিছু কথা তোমাকে বলতে চাচ্ছি। ক্লাস বাদ দিয়ে তোমার এখানে এসেছি কথাগুলো বলার জন্যে। মুশকিল হচ্ছে কথাগুলো বলতে পারছি না। জ্বরের ঘোর তৈরি না হলে বলা যাবে না।
চুপ করে শুয়ে থাক। এখন কিছু বলতে হবে না।
জ্বরের এই সুযোগটা আমার গ্রহণ করা উচিত। এই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলে আর কখনো হয়তো বলতে পারব না।
কথাগুলো কি খুবই জরুরি?
হ্যাঁ জরুরি। খুবই জরুরি।
যদি খুব জরুরি হয়, তাহলে জ্বর লাগবে না। তুমি এম্নিতেই কথাগুলো বলবে। হয়তো একটু বেশি সময় নেবে। তাছাড়া জরুরি কথা খুব গুছিয়ে বলতে হয়। মাথায় জ্বর নিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারবে না।
আমি কি এলোমেলোভাবে কথা বলছি?
না, তা বলছ না।
তাহলে কথাগুলো আমি এখনি বলব। তার আগে এক গ্লাস ঠাণ্ডক্স পানি খাব। ঠাণ্ডা পানি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। এখানে বরফ পাওয়া যায় না, তাই না?
সিদ্ধিরগঞ্জ বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে বরফকল আছে। আমি সুজাত মিয়াকে বরফ আনতে পাঠিয়েছি।
কখন পাঠিয়েছ?
তুমি যখন গোসল করছিলে তখন।
থ্যাংক য়ু। বরফ আসছে শুনেই ভালো লাগছে। তুমি মানুষটা খুবই গোছানো। তোমার মতো স্বামী পাওয়া যে-কোনো মেয়ের জন্যে ভাগ্যের ব্যাপার। হয়তো আমার জন্যেও।
হয়তো বলছি কেন? সন্দেহ আছে?
হ্যাঁ, সন্দেহ আছে। বাতি নিভিয়ে দাও চোখে আলো লাগছে।
আনিস বাতি নিভিয়ে দিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাচ্ছিলে বল।