আমার বাবাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ভয়ঙ্কর লজা দেয়া হয়েছে। বাবা আত্মঘাতী হয়েছেন। যারা এই কাজটা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা।
জহির খাঁ খুবই মজা পাচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, কর, মামলা করা। থানা এখান থেকে দূরে আছে। প্রথমে নান্দাইল রোড যাও। সেখানে রিকশা পাবে। মামলা ছাড়া আরো কিছু করার ইচ্ছা আছে?
জ্বি।
বল। সব এক সঙ্গে শুনি।
এখানে বাবার কবর হয়েছে। তার লাশ তুলে আমি আমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই।
এটা করতে পারলে ভালোই হয়। কাঠের বাক্সে করে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব না। মুনশি মৌলবিরা কী বলে আগে জানতে হবে। তারা যদি বলেন লাশ নেয়া যাবে তাহলে নিয়া যাবে।
মুনশি মৌলবির কথা দিয়া কী হবে? মুনশি মৌলবিরা তো আমার বাবার জানাজাও করে নাই।
কাজটা যে তারা ইচ্ছা করে করেছেন তা তো না। তাঁরা কাজ করেছেন হাদিস কোরান দেখে। যাই হোক, তুমি খাওয়া-দাওয়া করেছ?
না।
পরিশ্রান্ত হয়ে আসছি। বিশ্ৰাম কর। গোসল কর। তারপর খাওয়া-দাওয়া করা। তোমার থাকার জন্য একটা ঘর দিতে বলে দিব। কোনো অসুবিধা নাই। তোমার পিতা যখন প্রথম এখানে এসেছিলেন তখন প্ৰায় দুই বছর আমার বাড়িতেই ছিলেন। পরে মসজিদের কাছে তারে ঘর ওঠায়ে দেয়া হয়েছে।
আমি আপনার এখানে থাকব না।
কোথায় থাকতে চাও?
মসজিদের কাছে বাপজান যে বাড়িতে থাকতেন সেখানে থাকব।
তোমার সাথে কে এসেছে?
কেউ আসে নাই।
মামলা মোকদ্দমা, লাশ কবর থেকে তোলা–সময়ের ব্যাপার। তোমাকে কয়েক দিন থাকতে হইতে পারে। একা থাকবা?
হ্যাঁ, একা থাকব।
ভয় পাইতে পার। নানান কথা এখন শোনা যায়। তোমার পিতাকে নিয়েই কথা। তুমি বোধহয় শুনেছ।।
জ্বি আমি শুনেছি। এইজন্যেই আমি আরো বেশি করে থাকতে চাই।
ভূত-প্রেতের কথা বাদ দাও। ভূত-প্রেতের চেয়েও খারাপ জিনিস হলো মানুষ। এই অঞ্চলে খারাপ মানুষের অভাব নাই। তুমি অল্প বয়েসী মেয়ে–একলা থাকব!
আমি ভয় পাই না। আপনি আমার থাকার ব্যবস্থা করে দেন।
খাওয়া-দাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে?
আমি চাল-ডাল কিনে নেব। নিজেই রান্না করে খাব।
জহির খাঁ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন–ভর দুপুরে আমার বাড়িতে আসছি। এই বেলা খাওয়া-দাওয়া কর। তারপর না হয় তুমি যেটা চাইতেছ সেটার ব্যবস্থা করা যাবে।
আমি আপনার এখানে খাব না।
আমি গৃহস্থ মানুষ। দুপুরে গৃহস্থের বাড়িতে না খেলে অকল্যাণ হয়।
আপনি মনে কিছু নিবেন না। আমি আপনার এখানে খাব না।
আচ্ছা ঠিক আছে।
বোরকাওয়ালি উঠে দাঁড়াল। জহির খাঁ তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটা লম্বা। তার বাবা ছোটখাট মানুষ ছিলেন। মেয়ে বাবার মতো হয় নি। আবার ব্যবহারেও অমিল আছে। বাপ ছিল মেদামারা। মেয়ে শক্ত ধরনের। মেয়ের জিদ আছে। তবে মেয়েছেলের জিদ থাকা খারাপ। পুরুষের জিদ ভালো। কথায় আছে–
জিদের পুরুষ হয় বাদশাহ
জিদের মেয়ে হয় বেশ্যা।
জহির খাঁ ভ্রূ কুঞ্চিত অবস্থায় থাকল। তিনি চিন্তিত বোধ করছেন না, তবে তার ক্ষিধা নষ্ট হয়ে গেছে।
তার গোসলের পানি ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে–পানি আবার গরম করতে গেছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। তার খাস লোক–বদি মিয়া শরীরে তেল মাখাতে শুরু করেছে। রসুন দিয়ে জ্বাল দেয়া খাঁটি সরিষার তেল। এর সঙ্গে চায়ের চামচে দুই চামচ মধু মেশানো হয়েছে। এতে শরীরের বাহিরটা ঠাণ্ডা থাকে। গোসলের ঠিক পরে পরে আধা গ্লাস তোকমার সরবত খান। তোকমার সরবত শরীরের ভেতরটা ঠাণ্ডা রাখে। ভেতর বাহির দুই দিক ঠাণ্ডা রাখতে হয়।
বদি মিয়া।
মেয়েটার কথাবার্তা কেমন শুনলা?
ভালো। তেজি আছে।
তেজ কয় প্রকার জান?
জ্বে না।
তেজ দুই প্রকারের। মুখের তেজ আর কাজের তেজ। যাদের মুখের তেজ থাকে তাদের কাজের তেজ থাকে না। যাদের কাজের তেজ থাকে তারার মুখে কোনো তেজ থাকে না।
খুবই সত্য কথা।
যে কুত্তা ঘেউ ঘেউ করে হেই কুত্তায় কামড়ায় না।
অতি সত্য কথা।
জহির খাঁ অলস গলায় বললেন, দেখি এখন একটা শিলুক ধর। ভাঙাইতে পারি কি-না দেখি।
গা দলাই মলাইয়ের সময় জহির খাঁ খুব হালকা মেজাজে থাকেন। বদিকে তখন শ্লোক ধরতে বলেন। জহির খাঁ শ্লোক ভাঙিয়ে অত্যন্ত আনন্দ পান। শ্লোক ভাঙানোর ব্যাপারে তার দক্ষতা আছে। বদি তাকে আটকাতে পারে না।
বদি পিঠে তেল ডালতে ডিলতে বলল—
মাইয়া লোকের হাতে নাচে
সাত শ’ মুখ কার আছে?
জহির খাঁ চোখ বন্ধ করে বললেন–মেয়ে মানুষের হাতে নাচে? সাত শ’ মুখ–চালুনি। চালুনি চালে মেয়েরা। চালুনির হাজার হাজার ফুটা। হয়েছে?
জ্বে হইছে। কন দেখি–
জলেতে জন্ম তার জলে ঘর বাড়ি
ফকির নহে ওঝা নহে মুখে আছে দাড়ি।
জহির খাঁ বললেন–চিংড়ি মাছ।
বদি আনন্দের সঙ্গে বলল–আপনেরে আটকানি কঠিন। আচ্ছা দেখি এইটা পারেন কি-না!
নৌকা নহে জলে চলে শূন্যতেও চলে
দিনেতে দেখি না তারে দেখি নিশাকালে
কহেন কবি কালিদাস।
এই শিলুক যে ভাঙতে পারে সে আমার দাস।
জহির খাঁর মুখের হাসি বন্ধ হয়ে গেল। ভুরু কুঁচকে গেল। এই শ্লোকটা তিনি ভাঙ্গাতে পারছেন না। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন–এখন শরীরে পানি ঢালার ব্যবস্থা কর।
বন্দি পানি ঢালতে শুরু করল। জহির খাঁ বিরক্ত মুখে বসে রইলেন। বদিকে জিজ্ঞেস করলেই সে বলবে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে না। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কবি কালিদাসের দাস হবার অপমানটা গায়ে বিঁধছে।
বদি।
জ্বে।
ডাক্তার সাব আর তার স্ত্রীরে আইজ রাইতে আমার সাথে খানা খাইতে বলবা।