আজিজ মিয়া সকাল থেকেই আনিসের ক্লিনিকে বসে আছে। ভূতের ভয়ে রাতে তার ঘুম হয় না। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় ইমাম সাহেব তার আশেপাশে আছেন। আজিজ মিয়া ডাক্তারের কাছে এসেছে ঘুমের ওষুধ নিতে। সেই ওষুধ তাকে আগেই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে যাচ্ছে না। আনিসের ধারণা মানুষটা তাকে গোপন কিছু কথা বলতে চায়। ক্লিনিক ফাঁকা হবার পর আনিস বলল, আজিজ সাহেব। আপনি কি আরো কিছু বলবেন?
আজিজ মিয়া অপ্রস্তুত গলায় বলল, না। কোনো কাজ নাই, এইজন্যেই আপনার সামনে বসে আছি। আপনে রোগী দেখেন–এইটা আমার দেখতে ভালো লাগে।
আনিস বলল, আজকের মতো রোগী দেখা শেষ। আমি এখন উঠব।
আমিও উঠব ডাক্তার সাব। চলেন। আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত আগায়ে দেই।
নিশ্চিত যে আপনি আমাকে কিছু বলতে চান। বলুন শুনি।
আজিজ মিয়া বিব্রত গলায় বলল, মনটা অত্যাধিক খারাপ–এইটা বলতে চাই আর কিছু না।
মন খারাপ কেন?
জহির খাঁ সাব আমারে দেখতে পারেন না। আমি কিছুই করি নাই, তারপরেও আমারে দেখতে পারেন না। এই জন্যে মনটা খারাপ।
আপনাকে দেখতে পারেন না। কীভাবে বুঝলেন?
এইটা না বুঝার কোনো কারণ নাই। শখের জন্যে আড়ং-এর একটা ষাঁড় কিনিছিলাম, উনার ধারণা হয়েছে। আমি পাল্লা পাল্লি খেলায় নামছি। মনটা অত্যাধিক খারাপ ডাক্তার সাব। রাইতে যে আমার ঘুম হয় না। এইটাও একটা কারণ। খুবই মন কষ্টে আছি ডাক্তার সাব। কখন কী হয়!
কখন কী হয় মানে কী?
মানে কিছু না, এমেই বললাম। আমার সামান্য টেকা পয়সা হইছে। এইটা সত্য। তয় উনার সাথে পাল্লা দিব এইটা কেমন কথা?
আনিস বলল, তুচ্ছ জিনিস নিয়ে মন খারাপ করে থাকবেন না। জহির সাহেবের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ আছে–সম্পর্ক ভালো হবে।
আজিজ সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল–সম্পর্ক ভালো হওনের কোনো আশা নাই। এমন বিপদে পড়েছি। এখন একলা চলাফেরা করি না। লোকে ভাবতেছে ভূতের ভয়ে একলা চলাফেরা বন্ধ করেছি। ভূতের ভয়ে বাজারে লোকজনের মধ্যে থাকি। আসলে ঘটনা অন্য। কাউকে না বইল্যা পারতেছিলাম না বইল্যা আফনেরে বললাম। গ্রামের পলিটিক্স–বড়ই কঠিন পলিটিক্স। আপনে শহরের ছেলে আপনে বুঝবেন না। কোনদিন শুনবেন আমার মরা লাশ পুসকুনিতে ভাসতেছে! গ্রামে রটনা হইব। ভূতে আমারে পুসকুনিতে ফেইল্যা মারছে।
আনিস বাসায় ফিরল দুপুর একটায়। বাসা তালাবন্ধ। নবনী নেই, সুজাত মিয়াও নেই। বাড়ির বাইরের উঠানে আনিসের চুরি যাওয়া সাইকেল। কেউ একজন সাইকেলটা রেখে গেছে। আনিসের ভ্রূ কুঁচকে গেল। চুরি যাওয়া সাইকেল ফেরত পাওয়া আনন্দের ঘটনা। সমস্যা হলো–এখন এই সাইকেল নিয়ে নানান গল্প শুরু হবে। ডাক্তারকে সাধারণ মানুষের স্তর থেকে টেনে রহস্যমানবের স্তরে আনার প্রক্রিয়ায় সাইকেল ফেরত পাওয়ার ঘটনাটাও কাজ করবে।
জহির উদ্দিন খাঁ ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন।
বেলা দ্বিপ্রহর। তার ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে। গরম পানি আনা হয়েছে। জলচৌকিতে বসে তিনি গোসল সারবেন। গোসলের আগে তাঁকে কিছুক্ষণ দলাই মলাই করা হবে। এতে তার ক্ষুধা বৃদ্ধি হবে। দুপুরের খাবারটা আরাম করে খাবেন। দুপুরে খাবারের পর দুই ঘণ্টা দিবানিদ্রা। তার দীর্ঘদিনের রুটিন। রুটিনে ব্যতিক্রম করলেই শরীর জানান দেয়। গরম পানির বদলে একদিন যদি ঠাণ্ডা পানি গায়ে দেন– সঙ্গে সঙ্গে গা ম্যাজ ম্যাজ। বন্দ হজম।
রুটিনের ব্যতিক্রম তিনি সচরাচর করেন না। আজ মনে হয় করতেই হবে। তার সামনে বেঞ্চে একজন বোরকাওয়ালি বসে আছে। এই বোরকা কঠিন বোরকা। বোরকার পেছনের মুখ দেখা দূরে থােক, চোখও দেখা যাচ্ছে না। বোরকাওয়ালির পরিচয় এবং উদ্দেশ্য জেনেও জহির উদ্দিন খাঁ বিস্মিত। মনে মনে বলেও ফেলেছেন–মেয়েমানুষ মেয়েমানুষের মতো থাকতে হয়। মেয়েমানুষ পুরুষ হবার চেষ্টা করলে সমূহ বিপদ। একমাত্র কেয়ামতের আগে আগে মেয়েমানুষকে পুরুষের ওপরে স্থান দেয়া হবে। তখন তাদের চোখের ইশারায় সংসার চলবে। পুরুষ হবে ছাগলের মতো। তাদের একমাত্র কাজ হবে স্ত্রীর দিকে করুণ নয়নে তাকিয়ে ভ্যা ভ্যা করা। কিন্তু সেই কেয়ামতের তো এখনো দেরি আছে।
জহির উদ্দিন খাঁ বোরকাওয়ালির নাম আগে একবার শুনেছেন। তারপরেও মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে বললেন–তোমার নাম যেন কী বললা?
বোরকাওয়ালি শান্ত কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল, আমার নাম সকিনা।
তুমি ইমাম ইয়াকুব মোল্লার মেয়ে?
জ্বি।
তোমারই বিবাহের কথা চলতে ছিল? পাত্র কলেজের শিক্ষক?
জ্বি।
বিবাহ হয়েছে?
জ্বি, না। বিবাহ ভেঙে গেছে।
আফসোস! বিবাহ ভাঙল কেন?
বোরকাওয়ালি সহজ কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল–পাত্ৰপক্ষ বাপজানের খবরটা পেয়েছিল। তাকে নেংটা করে হাঁটানো হয়েছে, তিনি ফাঁস নিয়ে মরেছেন। এইসব খবর শুনলে আত্মীয়তা হয় না।
জহির খাঁ গম্ভীর গলায় বললেন–তুমি খবর যা পেয়েছ তার মধ্যে কিছু ভুল আছে। তাকে নেংটা করে হাঁটানো হয় নাই। শাস্তি আমি দিয়েছি, আমি জানি। সে রকম শাস্তিই দেয়ার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত দেয়া হয় নাই। তার পরনের পায়জামা খোলা হয় নাই। তুমি নিজে যখন এসেছি খোঁজ-খবর নাও। রটনা বিশ্বাস করা ঠিক না।
বাবাকে এই শাস্তি কেন দেয়া হলো এটা নিয়েও আমি খোঁজ-খবর করব।
কর। অনুসন্ধান করে দেখ। কন্যা হিসাবে এটা তোমার কর্তব্য।
আমি একটা মামলাও করতে চাই।
জহির খাঁ অবাক হয়ে বললেন, কী! মামলা?