নবনী বলল–আশেপাশে কোনো বীজ আছে? নদীর ওপর পুল?
সুজাত মিয়া বলল–আছে।
কোথায়? সামনে না পেছনে?
সামনে। তালবন্দির পুল। যাইবেন?
নবনীর খুবই যেতে ইচ্ছা করছে। বীজটাও স্বপ্নের ব্রীজের মতো কি-না, দেখা দরকার। কিন্তু আজ না। অন্য আরেক দিন যাবে। একা একা যাবে। হয়তো কালই যাবে।
সুজাত মিয়া।
জ্বি।
যেভাবে শিখিয়েছি ঠিক সেভাবে চা বানাও তো। রেললাইনের ওপর পা ছড়িয়ে বসে চা খাব।
ট্ৰেইন আসব। ট্ৰেইন আসনের সময় হইছে। দুপুরের ট্রেইন।
আসুক না ট্রেইন। ট্রেইন ট্রেইনের মতো আসবে। আমরা আমাদের মতো চা খাব।
নবনী ট্রেনের লাইনের ওপর বসেছে। কী মনে করে যেন মাথার ওপর ধরে রাখা ছাতাটা ছুড়ে ফেলল। বাতাস লেগে সেই ছাতা ভাসতে ভাসতে কাশফুলের দিকে যাচ্ছে।
সুজাত মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে বেশ চিন্তিত বোধ করছে। জিনের আছর হয় নি তো? মেয়ে রূপবতী হলে জিনের নজর হবেই। সেই মেয়ে যদি ভর দুপুরে খোলা চুলে জঙলার ভেতর দিয়ে যায় তাহলে তো কথাই নেই।
আনিসের ক্লিনিকে আজ রোগীর খুব ভিড়। এর মধ্যে একজন এসেছে সাপেকাটা রোগী। এই সময় সাপেকাটা রোগী আসে না। শীত আসতে শুরু করেছে, সাপদের এখন দীর্ঘ দিনের জন্যে গর্তে ঢোকার প্রস্তুতি নেবার সময়। মানুষের গায়ে ছোবল দেওয়ার চেয়েও তারা ব্যস্ত থাকে ঘুমোবার আয়োজনে।
সাপেকাটা রোগীকে ঘিরে বেশ ভিড়। রোগীর বয়স চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ। অন্ত বলশালী ব্যক্তি। সে ঝিম মেরে গেছে। রোগীর ছেলেমেয়ে এবং দুই স্ত্রী চলে এসেছে। দু’জন স্ত্রীই পাল্লা দিয়ে কাঁদছে। আনিস রোগীর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আগে সাপেকাটা রোগীকে কেউ ক্লিনিকে আনত না। ওঝা ডাকিয়ে ঝাড় ফুক করত। আজকাল ক্লিনিকে আনছে। আনিস এন্টি ভেনম ইনজেকশন কিছু আনিয়ে রেখেছে। ইনজেকশনগুলো দামি। ঠাণ্ডায় রাখতে হয়। ক্লিনিকে ফ্রিজ নেই। গরমে ইনজেকশনগুলোর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবার কথা। তাছাড়া একেক ধরনের সাপের জন্যে একেক রকম এন্টি ভেনম। কোন সাপে কামড়েছে তা জানা দরকার। আনিসের ধারণা গ্রামের মানুষরা সাপের সঙ্গে বাস করলেও সাপ চেনে না। সাপে কাটা রোগী, যে নিজের চোখে সাপকে ছোবল দিতে দেখেছে সেও সাপটা কী রকম বলতে পারে না। কী সাপ? প্রশ্ন করলে একটাই উত্তর–কাল সাপ।
আনিসকে দেখে রোগী হাউমাউ করে উঠল–ডাক্তার সাব আমারে বাঁচান। কাল সাপ দংশন করছে। রোগীর কান্না শুনে তার দুই স্ত্রী আরো উঁচু গলায় কান্না শুরু করল। এই দু’জনের মধ্যে পাল্লা-পাল্লি ব্যাপার আছে। দু’জনই চেষ্টা করছে কে কার চেয়ে বেশি শব্দ করে কাঁদতে পারে। রোগী ওদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল–চুপ। দু’জনই সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেল।
কোথায় কামড় দিয়েছে?
বুড়া আঙ্গুলের চিপাত।
সাপটা দেখেছেন?
আবছা আবছা দেখছি–কাল সৰ্প।
দুই আঙ্গুলের ফাঁকে গভীর ক্ষত। সাপ দাঁত ফুটিয়ে এমন গভীর ক্ষত কখনোই করবে না। পুরা পা নীল হয়ে ফুলে উঠেছে। এটা হয়েছে শক্ত করে দড়ি দিয়ে বঁধার জন্যে। মাংস কেটে দড়ি ডেবে আছে।
পাও জ্বইল্যা যাইতেছে ডাকতার সাব।
কতক্ষণ আগে কামড়েছে?
সইন্ধ্যা রাইতে ছোবল দিছে। পিসাব করতে জঙ্গলাতে গেছিলাম তখন ঘটনা ঘটছে। গত বচ্ছরও এই জঙ্গলাত সাপের ছোবলে মানুষ মরছে। এই বছর মরব আমি।
পায়ে বাঁধন কখন দিয়েছেন?
রাইতেই বান দিছি। খবর পাইয়া আমার বড় বউ-এর বাপের বাড়ি থাইক্যা ছোট শ্যালক আসছে। হে শক্ত বান দিছে।
আনিস বলল, আপনাকে সাপে কামড়ায় নি। কাটার খোঁচা লেগেছে। পায়ের বাঁধন খুলে দিলেই জ্বলুনি কমবে।
আমি নিজের চউক্ষে সাপ দেখছি ডাকতার সাব।
আপনার হাতে টর্চ হারিকেন এইসব কিছু ছিল?
জ্বি না। তাহলে সাপটা দেখবেন কীভাবে? জঙ্গলে আলো কোথায়? কৃষ্ণপক্ষের রাত।
রোগী চুপ করে গেল! আনিস তার পায়ের বাঁধন কেটে দিয়ে বলল–গরম চা এক কাপ খান। খেয়ে বাড়ি চলে যান।
রোগী গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল। রোগীকে ঘিরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা খানিকটা হতাশ হলো। সাপে কাটা রোগী গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসার মধ্যে কোনো নাটকিয়তা নেই। এই গল্প কাউকে করলে সে মজা পাবে না। সাপে কাটা রোগী মারা গেছে, কলার ভেলায় তাকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে–এই গল্প মজার। এই গল্প করতেও আনন্দ, শুনতেও আনন্দ।
রোগী বিড়ি ধরিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে টানছে। এক স্ত্রী পাখা দিয়ে তাকে বাতাস করছে। অন্য স্ত্রী স্বামীর সেবা করার কোনো কিছু না পেয়ে মন খারাপ করেছে। রোগী আনিসের দিকে তাকিয়ে বলল, ডাক্তার সাব আমি চইল্যা যাইতেছি। আমার নামটা একটু ইয়াদ রাইখেন, আমার নাম হেকিম আলি। ঝিলকান্দার হেকিম আলি। আফনের যে-কোনো প্রয়োজনে আমি জান দিয়া দিব। আফনে আমারে জীবন দিয়েছেন এই জীবন আমি আফনেরে দিয়া দিলাম। ঝিলকান্দার হেকিম আলি দেনা রাখে না।
আনিস বলল, আমি জীবন দিব কী? আপনাকে তো সাপেই কামড়ায় নি।
হেকিম আলি বিড়িতে লম্বাটান দিয়ে নিচু গলায় বলল–আমারে যে সাপে কাটছে এইটা আমি জানি, আপনে জানেন না। সাপের বিষ ক্যামনে আপনে পানি বানাইছেন সেইটা আফনে জানেন। আমি জানি না। আমার জানার দরকারও নাই। তয় ডাকতার সাব একটা কথা আপনেরে বইল্যা যাইতেছি, হেকিম আলি তার জেবন আপনের হাতে দিয়া গেল। নামটা ইয়াদ রাখবেন–ঝিলকান্দার হেকিম।
আনিস বিরক্ত বোধ করছে। অঞ্চলের লোকজন তাকে নিয়ে গল্প গাথা বানানো শুরু করেছে। তার মধ্যে রহস্যময়তা আরোপ করার চেষ্টা করছে। গ্রামের মানুষ রহস্যমানব তৈরি করতে পছন্দ করে। আনিস জানে সে যে মাঝে মাঝে শ্মশানঘাটায় বসে থাকে তা নিয়েও গল্প তৈরি হয়েছে। এইসব গল্পের ফল বেশির ভাগ সময়ই শুভ হয় না।