বুঝলি মর্জিনা–আল্লাপাকের কুন্দরতির শেষ নাই। পরিষ্কার দিন। নীলা আসমান। হঠাৎ বাজ পড়ার মতো শব্দ। দৌড় দিয়া ঘর থাইক্যা বাইর হইয়া দেখি মাথার ওপর দিয়া উড়াজাহাজের মতো কী জানি যায়। শো শো বো বেঁ শব্দ। চউখ কচলাইয়া তাকাইলাম।–না উড়াজাহাজ না, বটগাছ। বিরাট বটগাছ আমার বাড়ির ওপরে দিয়া উড়াল মাইরা যাইতেছে। ঘটনা এইখানে শেষ না। বটগাছে এক মাইয়্যালোক বসা। পানের বাটার মতো গোল মুখ। ঠোঁট টকটকা লাল। মনে হইতাছে এইমাত্র রক্ত খাইয়া আসছে–ঠোঁটে রক্ত লাইগ্যা আছে। তার পরনে একটা কাপড় দূরের কথা, সুতা পর্যন্ত নাই।
মর্জিনা গল্পটা পুরো বিশ্বাস করবে। মেয়ে মানুষের যে স্বভাব বিশ্বাস করলেও ভাব দেখাবে বিশ্বাস করে নাই। মুখ ঝামটা দিয়ে বলবে, আফনে এমন মিছখোর। খালি মিছা কথা। বটগাছের ওপরে নেংটা মেয়েছেলে। ছিঃ।
মতিকে তখন আল্লাখোদার নামে কীরা কাটতে হবে। এতে কিছু পাপ হবে। কোনো এক জুম্মাবারে মসজিদে গিয়ে তওবা করে পাপ কাটাতে হবে। ডাক্তার সারাগ্রাম ঘুরে এখন দাঁড়িয়ে আছে মগড়া খালের কাছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলেও এই জায়গায় কী করে জানি খানিকটা আলো আটকে আছে। শীতকালে খালে কোনো পানি থাকে না। এখন আশ্বিন মাস, পায়ের পাতা ডোবার মতো পানি আছে। পাহাড়ি নদীর পানির মতো এই খালের পানি চকচক করছে। মগড়া খাল মূল যে নদী থেকে এসেছে তার পানি ঘোলা অথচ এই খালের পানি সবসময়ই ঝকঝকে পরিষ্কার। দেখলেই আজলা ভর্তি পানি নিয়ে চোখে মুখে দিতে ইচ্ছা করে।
ডাক্তার জংলী কাঠগোলাপ গাছে হেলান দিয়ে সাইকেলটা রাখল। সাইকেলের কেরিয়ারে বাধা পেটমোটা চামড়ার ব্যাগ হাতে নিল। মাগড়া খালের পাশে সুন্দর বসার ব্যবস্থা আছে। জনৈক বিধুভুষণ চক্রবর্তীর বানানো গোলাকৃতি ঘর। যে ঘরের মেঝে, শ্বেতপাথরে বাঁধানো। একসময় মগড়া খাল বিশাল নদী ছিল। তার নাম ছিল হাবলংগা নদী। নদীর তীরে ছিল মহাশ্মশান। দূর দূরান্ত থেকে খাঁটিয়ায় করে মরা আসত। সেই সময় বিধুভুষণ চক্রবর্তী শঙ্কুশান যাত্রীদের জন্য এই ঘর বানিয়ে দেন। নিজের কর্মকাণ্ডও দেয়ালে লিখে রাখেন–
শ্মশানবন্ধুর কল্যাণ কর্মে
অনাথ কাঙালি বিধুভুষণ চক্রবর্তী
কর্তৃক বঙ্গতারিখ ১৩২০ সনে নির্মিত।
শুধুমাত্র ব্ৰাহ্মণ প্রবেশ করিবেক
অন্যথায় মহাপাতকী হইবেন।
দেড়শ বছরে হাবলংগা নদী হোজেমেজো হয়ে গেছে মগড়া খাল। শ্মশানবন্ধুদের কল্যাণকৰ্মে নির্মিত ঘর ধ্বসে গিয়েছে। উত্তরদিকের দেয়াল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে শ্বেতপাথরের মেঝে অবিকৃত আছে। জোছনার সময় মেঝে থেকে জোছনা ঠিকরে পড়ে। ডাক্তার লোক লাগিয়ে মেঝে পরিষ্কার করিয়েছে। সে মাঝে মাঝে এখানে এসে বসে, যদিও জায়গাটা বিপজ্জনক। গত বৎসর দুটা গরু এই জায়গায় সাপের কামড়ে মারা গেছে। তার আগের বছর এক ভিখিরিণী মারা গেছে। ভিখিরিণীর পরিচয় উদ্ধার হয় নি। মনে হয় অনেক দূরের কোনো গ্রাম থেকে ভিক্ষা করতে করতে এদিকে চলে এসেছিল। দুপুরে ক্লান্ত হয়ে আঁচল পেতে নির্জন শ্মশান ঘরে শুয়েছিল। সেখানেই তাকে সাপে কাটল।
ডাক্তার চামড়ার ব্যাগ খুলে পেটমোটা একটা শিশি বের করে শিশির মুখ খুলল। ছড়িয়ে পড়ল কাৰ্বালিক এসিডের কড়া গন্ধ। সে যতক্ষণ এখানে থাকে মুখ খোলা অবস্থায় কার্বালিক এসিডের বোতলাটা পাশে থাকে। যে-কোনো পুরনো ধ্বংসস্তুপ হলো গোখরা সাপের আস্তানা। প্রচণ্ড বিষধর সাপ ভীরু প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাদের স্বভাব হলো মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকা। এই ক্ষেত্রে মানুষেরও কিছু করণীয় আছে। মানুষদের উচিত তাদের উপস্থিতি জানান দেয়া।
ডাক্তারের চায়ের পিপাসা পেয়েছে। তার পেটমোটা ব্যাগে চায়ের সব সরঞ্জামই আছে। ফ্লাস্ক ভর্তি ফুটন্ত গরম পানি। টি ব্যাগ, চিনি। আল গ্রে চায়ের একটি টিনের কৌটাও আছে। আল গ্রে চায়ের বিশেষ গন্ধটা নবনীর অতি প্রিয়। এই কৌটার মুখ এখনো খোলা হয় নি। সামনের সপ্তাহেই নবনীর আসার কথা। তখন খোলা হবে।
চা বানানোর সরঞ্জাম ব্যাগ থেকে বের করা হয়েছে। সন্ধ্যা মিলিয়ে যাবার পরেও জায়গাটা পুরোপুরি অন্ধকার হয় নি। অবশ্যি অন্ধকার হলেও সমস্যা নেই। ব্যাটারিতে চলে এমন একটা ছোট্ট লণ্ঠন ব্যাগে আছে। চা কড়া হয়ে গেছে–তারপরেও চুমুক দিয়ে আনিসের ভালো লাগল। সে ব্যাগের ভেতর থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। মাস ছয়েক হলো সে সিগারেট ছাড়ার প্রাণপন চেষ্টা করছে। লাভ হচ্ছে না। সিগারেট খাওয়া বরং বেড়ে গেছে। নবনী এলে সিগারেট খাওয়া পুরোপুরি ছাড়তে হবে। নবনী সিগারেটের গন্ধ একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তার নাকি সিগারেটের প্যাকেট দেখলেই গন্ধে মাথা ধরে, বমি চলে আসে। গত সপ্তাহে নবনীকে চিঠি লেখা হয় নি। নির্জন জায়গায় বসে চট করে কয়েক লাইনের চিঠি লিখে ফেলা যায়। চিঠির সরঞ্জাম–কাগজ, বিলপয়েন্ট, খাম, ডাকটিকিট সবই তার মোটা ব্যাগে আছে। চিঠি লিখবে কি লিখবে না–আনিস মনস্থির করতে পারছে না। তার সিগারেট শেষ হয়েছে, সে আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। চিঠি লেখার পরিকল্পনা আপাতত বাতিল। তবে চিঠির ব্যাপারটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মস্তিষ্কের একটা অংশ গুটিগুটি করে চিঠি লেখা শুরু করে দিয়েছে। আনিস এখন যদি সাইকেলে উঠে রওনা দেয়। তবু চিঠি লেখা বন্ধ হবে না।