সুজাত মিয়া উত্তর দিল। না। চুপ করে রইল। নবনী বলল, এখন তোমাকে চা বানানো শেখাব। মন দিয়ে শিখবে। এরপর থেকে যেভাবে শেখালাম ঠিক সেইভাবে চা বানিয়ে দেবে। পারবে না?
সুজাত হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। নবনী বলল, চা বানানো শেখাবার পর আমি তোমাকে নিয়ে গ্রাম দেখতে বের হব। তোমাদের এখানে শ্মশান ঘাট আছে। তোমার ভাইজানের চিঠি পড়ে জেনেছি সেখানে শ্মশান বন্ধুদের একটা বসার ঘর আছে যার মেঝে, শ্বেত পাথরে বাঁধানো–আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে?
জ্বি, আইচ্ছা।
এইতো কথা বলেছ! এখন থেকে আমার সঙ্গে কথা বলবে–এসো এখন চা বানানো শেখাই–ওয়ার্কশপ অন টি মেকিং।
সুজত ফিস ফিস করে বলল, চা বানাইতে জানি।
নবনী কড়া গলায় বলল, বাজে কথা বলবে না–চা বানানো রন্ধনশিল্পের অতি কঠিন অংশ। খুব কম মানুষই এটা জানে। আমি কী করছি মন দিয়ে দেখ। প্রথমে কাপে দুটা টি ব্যাগ নিলাম। এক চামচ গরম পানি ঢেলে দিলাম টি ব্যাগে। ক্যাগের ভেতরের শুকনা। চা-পাতা এই পানিতে নরম হতে থাকবে। এই ফাঁকে চায়ের কাপ, চামচ ধুয়ে ফেলতে হবে গরম পানিতে… গরম পানিতে চায়ের চামচ, ধোয়া অতি জরুরি। এতে চামচটা গরম হয়। তা না করলে ঠাণ্ডা চামচ চা থেকে অনেকটা তাপ নিয়ে নেবে। চা হয়ে যাবে ঠাণ্ডা।
সুজাত কাছে এগিয়ে এসেছে। খুবই আগ্রহ নিয়ে চা বানানো দেখছে। সে নবনীর চোখের দিকে কোনো রকম সঙ্কোচ ছাড়াই তাকাচ্ছে।
নবনী বলল, তোমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে রেললাইন গিয়েছে না?
সুজাত মাথা নাড়ল। নবনী বলল, মাথা নাড়ানাড়ি করবে না, মুখে কথা বল। গ্রামের পাশ দিয়ে রেললাইন গিয়েছে?
দূর আছে। জংলা পার হইয়া যাইতে হয়।
তোমাদের এদিকে জঙ্গল আছে না-কি?
হুঁ।
কত দূর?
মেলা দূর।
হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া যাবে?
ফিরতে দিরং হইব। দুপুর পার হইব।
হোক দুপুর পার–চল রেললাইন দেখতে যাব। তোমার ভাইজান দুপুরে ভাত খেতে এসে দেখবে–ঘর তালাবন্ধ, কেউ নেই। সে আমাদের কোথাও খুঁজে পাবে না। মজা ভালোই হবে। রেললাইন দেখার পর যদি দেখি হাতে সময় আছে তাহলে মন্দির দেখতে যাব।
নবনী মিটিমিটি হাসছে। সুজাত মিয়ার মনে হলো–ভাইজানের স্ত্রী মানুষটা অন্য রকম। ভাইজান ভালো, তার স্ত্রীও ভালো। দুইজন দুই রকম ভালো। একটা ব্যাপার শুধু মিলছে না। ডাক্তার সাবের পরিবার অতিরিক্ত সুন্দর। যারা অতিরিক্ত সুন্দর তারা ভালো হয় না। তাদের মধ্যে বড় কোনো দোষ থাকে। এটা পরীক্ষিত।
নবনীর মাথায় বাহারী লাল রঙের ছাতা। সুজাত মিয়ার কাধে ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি চায়ের সরঞ্জাম। নবনী এগুচ্ছে দ্রুত পায়ে। ঝাঁঝাঁ রোদ। কিন্তু তার হাঁটতে ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে গরম বাতাসের ঝাপ্টা চোখে মুখে লাগছে। শরীর চিড়বিড় করে উঠছে। এই চিড়বিড়ানিও ভালো লাগছে। গ্রামের মানুষজন কৌতূহলী চোখে তাকে দেখছে। তাদের কৌতূহলী চোখের দিকে তাকাতেও মজা লাগছে। তারা কী ভাবছে জানতে পারলে ভালো হতো। এটা সম্ভব না। সুজাত মিয়া এখন বেশ সহজভাবেই নবনীর সঙ্গে গল্প করছে। তার গল্প বলার ভঙ্গি খুবই সংক্ষিপ্ত। গল্প শুরু করে সে চুপ করে যায়। বাকি অংশ প্রশ্ন করে করে বের করতে হয়। যেমন সুজাত মিয়া বলল–মেয়ে আসছে। হইলদা বোরকা।
নবনী বলল, কোন মেয়ে এসেছে বোরকা পরে?
ইমাম সাবের।
যিনি মারা গিয়েছেন সেই ইমাম সাহেব?
হুঁ। সকিনা।
সকিনা কি মেয়ের নাম?
হুঁ।
কবে এসেছে?
আইজ সকালে। খুব কানতেছিল।
কাঁদারই তো কথা। বাবা মারা গেছে। বাবার কবর দেখতে এসেছে। কাঁদবে না তো কী করবে? খিলখিল করে হাসবে?
দুই হাত দিয়া তেতুলগাছ ধইরা কানতেছিল। যে তেতুলগাছে তার বাবা ফাঁসি দিয়েছিল সেই তেতুলগাছ!
আহারে বেচারি।
তেতুলগাছ কাটাইয়া ফেলব। চেয়ারম্যান সাব হুকুম দিছে।
তেতুলগাছ কাটাবে কেন?
তেতুল গাছে দোষ লাগছে। মানুষ যে গাছে ফাঁস নেয়। হেই গাছে দোষ লাগে।
নবনী সুজাত মিয়ার দিকে তাকাল। গল্প শেষ হয়েছে না-কি আরো কিছু বাকি আছে সেটা জানার চেষ্টা। সুজাত নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তেতুল গাছটার তেতুল ছিল খুবই মিষ্টি।
নবনী ধমক দিয়ে বলল, বাজে কথা বলবে না সুজাত মিয়া। তেতুল কখনো মিষ্টি হয় না। তেতুলি একটা টক ফল।
আরবের তেতুল মিষ্টি হয়।
এটা তো আরব না, বাংলাদেশ। তাছাড়া ঐ তেতুল গাছের তেতুল আমি খেয়েছি। ভয়ঙ্কর টক। আমার সঙ্গে কখনো বানিয়ে কথা বলবে না। আমি নিজে কখনো বানিয়ে কথা বলি না। অন্যরা বললে রাগ করি। বুঝতে পারছ?
জ্বে।
সুজাত মিয়া তোমার ক্ষিধে লেগেছে?
না।
ক্ষিধে লাগলে বলবে। ব্যাগে বিসকিট আছে। আপেল আছে। রেল লাইন আর কতদূর?
দূর নাই।
অনেকক্ষণ থেকেই তো বলছি দূর নাই। তারপরেও তো দেখা পাচ্ছি না।
সুজাত মিয়া দাঁত বের করে হাসল। কারণ অনেকক্ষণ থেকে সে যদিও দূর নেই বলছিল–এখন সত্যিই আর দূর নেই–বাঁকটা পার হলেই রেল সড়ক।
নবনী রেল সড়কে উঠে এসেছে। সে খুবই বিস্মিত বোধ করছে। অবিকল এ রকম রেললাইন সে স্বপ্ন দেখেছে। কোথাও দৃষ্টি আটকাচ্ছে না। যতদূর চোখ যাচ্ছে ফাঁকা মাঠ। রেললাইনের দু’পাশে কাশবন। বাতাসে কাশফুল কাঁপছে। ঢেউয়ের মতো হচ্ছে। স্বপ্নের কাশফুলগুলো এভাবেই কাঁপছিল।
রেললাইনের শ্ৰীপারে পা রেখে রেখে নবনী এগুচ্ছে। তার শরীর কেমন ঝিম ঝিম করছে। স্বপ্নে সে এভাবেই হাঁটছিল। স্বপ্নে সে ছিল একা। এখানে তার পাশে আছে সুজাত মিয়া। পা ছোট বড় হলেও সুজাত দ্রুত হাঁটতে পারে।