আনিস বলল, এটা নতুন কিছু না।
নবনী বলল, ওনাদের ঝগড়া মান অভিমান আমার কিন্তু খুব পছন্দ। তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই আমার এরকম মজার ঝগড়া হবে না।
আনিস বলল, তা হবে না। আমি তাদের মতো না।
তুমি কী রকম?
একটু আলাদা।
কী রকম আলাদা?
আনিস জবাব দিল না। তার সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। নবনীর সামনে সিগারেট খাওয়া যাবে না। সে উঠে পড়ল। নবনী বলল, কোথায় যাও?
তুমি ঘুমানোর চেষ্টা কর। আমি একটা সিগারেট খেয়ে আসি।
আমার সামনেই খাও। কিছু হবে না।
আনিস বলল, না।
নবনীর দুঃস্বপ্নটা শুরু হয়েছে। শুরুটা সুন্দর। ঘুমের মধ্যেই নবনী বুঝতে পারছে এই সুন্দরের শেষটা ভালো না। শেষটা ভয়ঙ্কর। শেষটা সে আন্দাজও করতে পারছে। নবনী হাঁটছে। রেললাইনের স্ত্রীপারে পা রেখে রেখে। সামনেই বীজ, যাচ্ছে ব্রীজের দিকে। চারদিক খুব সুন্দর। সবুজে। সবুজ হয়ে আছে। বনজঙ্গল ঝোপ ঝাড় কিছু নেই। দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে না। আকাশ দেখা যাচ্ছে। সেই আকাশের রঙও হালকা সবুজ। নবনী বুঝতে পারছে, ব্রীজের ওপর ওঠা মাত্ৰই দুঃস্বপ্ন শুরু হবে। উল্টো দিক থেকে ট্রেন আসতে শুরু করবে। সে তখন না। পারবে ব্রীজ থেকে লাফ দিয়ে নিচে নদীতে পড়তে, না পারবে রেললাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে। সবচে’ ভালোবুদ্ধি হচ্ছে এক্ষুণি ট্রেনের লাইন থেকে সরে দাঁড়ানো। সেটাও সম্ভব না। স্বপ্নে স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছু নেই। স্বপ্ন হলো পরিপূর্ণ সমৰ্পণ। যিনি স্বপ্নে তাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি নবনীকে অবশ্যই ব্রীজে নিয়ে তুলবেন। মাঝামাঝি পর্যন্ত হাঁটিয়ে নিয়ে যাবেন, তারপর উল্টো দিক থেকে কোনো এক আন্তঃনগর ট্রেন ছেড়ে দেবেন। সেই ট্রেন দিগন্ত কাঁপিয়ে ঝড়ের গতিতে আসতে শুরু করবে। স্বপ্নের নিঃসঙ্গ জগতে তাকে রক্ষা করার কেউ থাকবে না।
নবনী এখনো বীজ পর্যন্ত পৌছায় নি, তার আগেই সে ঘুমের মধ্যে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল–আমাকে বাঁচাও। প্লীজ আমাকে বাঁচাও। ট্রেনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নবনী ছটফট করছে। তার ঘুম ভাঙানোর জন্য কেউ আসছে না।
ঘরে ঝলমলে রোদ
নবনীর ঘুম ভাঙ্গল অনেক বেলায়।
ঘরে ঝলমলে রোদ। জানালা ভেঙে পায়ের পাতায় রোদ পড়েছে। পা চিড়বিড় করছে। শরীরে আরামদায়ক আলস্য। রোদ থেকে পা সরিয়ে নিতেও আলসেমি লাগছে। রাতে রেললাইন ঘটিত দুঃস্বপ্নের পরেও ঘুম যে শুধু ভালো হয়েছে তা-না, খুব ভালো হয়েছে। ঘুমের ট্যাবলেট চমৎকার কাজ করেছে। ট্যাবলেটের নাম ধাম জেনে নিতে হবে।
সকালে জেগে ওঠার পরের দশ মিনিটের আলসেমির আনন্দের সীমা নেই। নবনীর খাটে উঠে বসতেও ইচ্ছা করছে না। কেউ যদি টেনে বিছানায় বসিয়ে দিত! কাজের ছেলেটার নাম মনে পড়ছে না। তাকে ডেকে ফুটন্ত পানির কথা বলতে হবে। এই ছেলে চা কেমন বানায় এখনো জানা হয় নি। দিনের প্রথম চা-টা খারাপ হলে পুরো দিনটাই নষ্ট হবে। দিনের প্রথমটা এবং রাতে ঘুমুতে যাবার আগে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি–নবনীর জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সে যে ক’দিন এখানে থাকবে–ঠাণ্ডা পানির সমস্যা হবে। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে ঠাণ্ডা পানি পাওয়া যাবে না, এটা ভেবে নবনীর এখনি খারাপ লাগছে।
আনিস যে বাড়িতে নেই এটা বুঝা যাচ্ছে। সিক্সথ সেন্স কি-না কে জানে! কে বাড়িতে আছে কে নেই এটা নবনী চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে। কেউ যখন বাড়িতে থাকে তখন তার শরীরের জীবন্ত গন্ধ বাড়িতে ভাসতে থাকে। সে চলে গেলে গন্ধটা চলে যায়–ছোটবেলায় এই পরীক্ষা সে অনেকবার দিয়ে অনেক লোকজনকে চমৎকৃত করেছে। এখনো এই পরীক্ষা দিলে ভালো নম্বর পাবে।
নবনী উঠে বসল। এমিতেই ঘুম ভাঙার পর তার মন প্ৰফুল্প ছিল–উঠে বসার পর মন প্ৰফুল্লতম হয়ে গেল। খাটের মাথার পাশে রাখা টেবিলে ফ্লাস্ক। ফ্লাস্কের পাশে টি ব্যাগ, চিনি, দুধ। কাজটা আনিস করে গেছে। ফ্লাস্কে গরম পানি যে আছে এটা নিশ্চিত। নবনী টেবিলের দিকে হাত বাড়াল। ফ্লাস্কের পাশে খাম। আনিস চিঠি লিখে গেছে। আনিসের হাতের লেখা ডাক্তারদের হাতের লেখার মতো জড়ানো না, স্পষ্ট সুন্দর অক্ষর। নবনী খাম খুলে চিঠি বের করল।
নবনী,
খুব আরাম করে ঘুমাচ্ছ বলে ঘুম ভাঙালাম না। সকাল আটটায় আমাকে ক্লিনিকে যেতে হয়। ভেবেছিলাম। আজ ছুটি নিয়ে তোমার ঘুম ভাঙার জন্যে অপেক্ষা করব। সম্ভব হলো না। ফ্লাস্ক ভর্তি গরম পানি রেখে গেলাম। আরো কিছু যদি লাগে– সুজাত মিয়াকে বলবে। সে ব্যবস্থা করবে। সে কথা বলে না, কিন্তু কাজে খুব দক্ষ। নাশতা খেয়ে নিও। আমার ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যাবে। দুপুরে কী খেতে চাও সুজাত মিয়াকে বলবে। তোমার যা খেতে ইচ্ছে করে বললেই সুজাত রোধে দেবে। ও সব রান্না জানে।
–আনিস
নবনী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গম্ভীর গলায় ডাকল–সুজাত মিয়া।
সুজাত দরজা ধরে দাঁড়াল। তার চোখ মেঝেতে। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে সে মেঝেতে অদৃশ্য নকশা করছে। দৃষ্টি সেই নকশায় নিবন্ধ। সুজাত মিয়া যে শুধু কথাই কম বলে তা-না, চোখের দিকেও তাকায় না।
তোমার ভাইজান চিঠিতে লিখেছে। আমি দুপুরে যা খেতে চাই তাই রোধে খাওয়াবে। পারবে?
সুজাত চোখের দিকে না তাকিয়েই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। নবনী গম্ভীর গলায় বলল, দুপুরে আমি পিজা খেতে চাই। পিজা বানাবে, ঠিক আছে?
সুজাত এবার চোখের দিকে তাকাল। এবং চট করে চোখ নামিয়ে নিল না, তাকিয়েই রইল। নবনী বলল–আমি এ বাড়িতে আসার পর থেকে লক্ষ করেছি তুমি কারোর চোখের দিকে তাকাও না। ক্রমাগত মেঝের দিকে তাকিয়ে থাক বলে তোমার ঘাড়াও বকের মতো বেঁকে গেছে। তুমি যাতে আমার চোখের দিকে তাকাও এজন্যেই পিজা খেতে চেয়েছি। আমি নিশ্চিত ছিলাম পিজা খেতে চাই শুনলেই তুমি চমকে আমার চোখের দিকে তাকাবে। বুঝতে পারছ কি বলছি? নবনী হাসিমুখে উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করছে।