আনিস বলল, মিঠাপুর বলে একটা জায়গায় রোগী দেখতে গিয়েছিলাম। রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ–ওরা আমাকে রেখে দিতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস থাকি নি।
নবনী বলল, রোদে পুড়ে তুমি তো দেখি ঝলসে গেছ।
আনিস হাসতে হাসতে বলল, তুমি খুব সুন্দর হয়েছ। চুল কেটেছ—তাই না?
হুঁ।
পথে অসুবিধা হয়েছে? একা একা আস কেন? কাউকে সঙ্গে নিয়ে এলেই হয়। এমন তো না যে তোমাদের বাড়িতে মানুষের অভাব।
নবনী হালকা গলায় বলল, একা আসি নি তো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নান্দাইল রোড স্টেশন পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন। আমি তোমার এখানে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। রাজি হন নি।
আনিস অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নবনী গম্ভীর গলায় বলল, উনার মাথায় হঠাৎ করে গান এসে গেল বলে আমিও জোর করি নি। গানের একটা লাইনই এসেছে, অন্য লাইনগুলো আসে নি। লাইনটা হলো—
‘আলো ভাঙার এই আলো।’
লাইনটা সুন্দর না?
আনিস বলল, কিছুই বুঝতে পারছি না। কার সঙ্গে তোমার দেখা? কোন রবীন্দ্ৰনাথ?
জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরু।
আনিসের মুখের হতভম্ব ভাব আরো প্রবল হলো। নবনী হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে বলল–তুমি এমন কাঠখোট্টা হয়ে যাচ্ছ কীভাবে? ঠাট্টা বুঝ না। ঠাট্টা করছিলাম।
ঠাট্টা করছিলে?
ইয়েস ডাক্তার সাহেব। তোমার চোখ মুখ শক্ত হয়ে যাচ্ছে, মনে হয় তুমি রেগে গেছ।
না। রাগি নি। তোমার মধ্যে ঠাট্টা করার প্রবণতা আছে। এটা ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমার ঠাট্টাগুলো অন্যরকম। হঠাৎ শুনলে ধাক্কার মতো লাগে।
নবনী বলল, গোসল করে এসো। খেতে বসব। আমার ক্ষিধে চলে গিয়েছিল আবার ফিরে এসেছে। এখন যদি চলে যায়। আর ফিরে আসবে না। আচ্ছা শোন, তোমাদের এখানকার ইমাম সাহেব না-কি ভূত হয়ে লোকজনদের ভয় দেখাচ্ছেন? মাতিকে শুনলাম আড়া করে পুকুরে নিয়ে ফেলেছে। সে আমাকে বলছিল।
আনিস চুপ করে রইল। নবনী বলল, হ্যাঁ না একটা কিছু বল।
আনিস বলল, এ রকম কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
তোমাকে উনি কখনো তাড়া করেন নি?
না। এই প্ৰসঙ্গটা থাক।
থাকবে কেন?
সব আলাপ এক সঙ্গে করে ফেললে কীভাবে? কিছু তোলা থাক।
থাক, তোলা থাক।
নবনীর ঘুম পাচ্ছে। সে হাই তুলতে তুলতে বলল, তোমার টেবিলের ড্রয়ারে দেখলাম একটা মেয়ের কয়েকটা ছবি। খুবই সুন্দর মেয়ে। সে কে?
জহির খাঁ সাহেবের ভাইস্তি।
তোমার ড্রয়ারে তার ছবি কেন?
চেয়ারম্যান সাহেব মেয়েটার বিয়ে দিতে চান। আমাকে পাত্র খুঁজতে বলেছেন। এইসব ছবি পাত্রিপক্ষকে দেবার জন্যে।
এই মেয়ের পাত্ৰ খোঁজার দরকার কী? পাত্ররাই তাকে খুঁজবে।
তা ঠিক।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে রাত এগারোটা বেজে গেল। আনিস বলল, টায়ার্ড হয়ে এসেছ শুয়ে পড়। আজ গরম কম আছে–ভালো ঘুম হবে। এই কদিন প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। তুমি তো আবার গরম একেবারেই সহ্য করতে পার না।
নবনী বলল, আমি শীতও সহ্য করতে পারি না। দুটাই আমার অসহ্য। তবে গরমটা বেশি অসহ্য। তোমাদের এখানে মশা কেমন?
মশা নেই।
তাহলে মশারি খাটাবে না। মশারির ভেতর আমার দমবন্ধ হয়ে যায়। নিঃশ্বাস নিতে পারি না।
বেশ তো মশারি খাটাব না।
তোমার কাছে আরেকটা অনুরোধ আছে।
কী অনুরোধ?
আগে বল অনুরোধ শুনে রাগ করবে না।
আনিস বিস্মিত হয়ে বলল, এমন কী অনুরোধ আছে যা শুনে রাগ করতে পারি?
রাগ করার সম্ভাবনা আছে বলেই তো বলছি। বল রাগ করবে না।
রাগ করব না।
নবনী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অনুরোধটা হচ্ছে। আমি একা ঘুমুতে যাব। দু’জন আলাদা শোব।
আনিসের মনে হলো নবনী ঠাট্টা করছে। সে বিচিত্র ধরনের ঠাট্টা করে–তার এই কথাটাও ঠাট্টা। আনিস যখন বলবে, আচ্ছা আলাদা খাটে ঘুমাও; তখনি নবনী খিলখিল করে হেসে উঠবে।
নবনী বলল, গম্ভীর হয়ে আছ কেন? কিছু বল।
আনিস বলল, কোনো সমস্যা নেই। আলাদা খাটে ঘুমাও।
নবনী বলল, থ্যাংক য়্যু।
তাকে দেখে মনে হলো সে এক ধরনের টেনশান বোধ করছিল, এখন আর সেই টেনশান নেই। সে নিশ্চিত বোধ করছে।
নবনী বলল, রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আগে আমি হালকা লিকার দিয়ে এক কাপ চা খাই। তুমি খাবে?
আনিস বলল, না।
নবনী বলল, তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমার ওপর রাগ করেছ। রাগটা চেপে আছ।
আমি রাগ করি নি। তুমি এই খাটে শোও। আমি পাশের ঘরে আছি।
ঐ ঘরে তো ফ্যান নেই। ঘুমুবে কীভাবে?
আমার অভ্যাস আছে।
নবনী বলল, রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে যদি চিৎকার করতে থাকি তুমি কিন্তু ধাক্ক দিয়ে আমার ঘুম ভাঙাবে।
দুঃস্বপ্ন কি রোজ রাতেই দেখ?
হ্যাঁ। আজ যে দেখব। এটা প্ৰায় নিশ্চিত। আজ হয়তো দেখব। ইমাম সাহেব আমাকে তাড়া করছেন।
আনিস বলল, ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাও। ঘুম গাঢ় হবে, স্বপ্ন দেখবে না।
নবনী ওষুধ খেয়ে সহজ গলায় বলল, ঘুম না। আসা পর্যন্ত এসো কিছুক্ষণ গল্প করি।
আনিস বলল, বেশ তো গল্প কর।
তুমি কি কিংবদন্তী ডাক্তার হয়ে গেছ? লোকজন তোমাকে নিয়ে নতুন কোনো গল্প বানিয়েছে? নাম কি এখনো ‘সাইকেল ডাক্তার’ আছে? সাইকেল নেই, ‘সাইকেল ডাক্তার’ নাম থাকার তো কথা না।
আনিস কিছু বলল না। নবনী বলল, আমি বড় মাছ রান্না করা শিখেছি। একদিন বড় মাছ আনিও তো। রান্না করে খাওয়াব।
আচ্ছা।
রান্না শিখেছি তোমার মা’র কাছে। ও বলতে ভুলে গেছি–এখানে আসার আগে তোমার বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা করে এসেছি। তাঁরা ভালো আছেন। তবে দুজনের মধ্যে আবার ঝগড়া হয়েছে। কথা বন্ধ। তোমার বাবা বাসায় খাচ্ছেনও না। হোটেল থেকে খেয়ে আসছেন।