রোগীর বাড়ির কাছাকাছি পৌছার পর রোয়াইল বাজারের এমবিবিএস ডাক্তার সাইফুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আনিসের দেখা হলো। সাইফুদ্দিন সাহেব মোটর সাইকেলে করে এসেছেন। মোটর সাইকেলের কেরিয়ারে ডাক্তারি ব্যাগ নিয়ে তার এসিসটেন্ট বসা। এসিসটেন্টের মুখও গম্ভীর। তাকে রোগী দেখার জন্যে আনা হয়েছে। তিনি আনিসকে দেখে ভুরু কুঁচকে ফেললেন। মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে আনিসকে হাতের ইশারায় এক পাশে নিয়ে গেলেন। গোপন কিছু কথা বলবেন–এইসব গোপন কথা রোগীর বাড়ির যে দু’জন আনিসকে নিয়ে আসছে তাদের শোনানো যাবে না।
সাইফুদ্দিন সাহেব গলা নামিয়ে বললেন–রোগী দেখার কিছু নাই। শেষ অবস্থা। ডাক্তার শিলাপটায় বেটে শরীরে মাখিয়ে দিলেও কিছু হবে না।
আনিস বলল, হয়েছে কী?
পানি এসে শরীর ফুলে গেছে। শ্বাসনালিও ফুলে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে–ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। রাতটা টিকবে না। ভিজিটের টাকা নিয়ে দ্রুত চলে আসবেন। অঞ্চলটা খারাপ। ডাক্তারের উপস্থিতিতে রোগী মারা গেলে খবর আছে।
আনিস চুপ করে রইল। সাইফুদ্দিন সাহেব গলা আরো নামিয়ে এনে বললেন–ভিজিটের টাকা নিয়ে এরা ঝামেলা করে নাই। দুইশ টাকা ভিজিট চেয়েছিলাম দিয়েছে। মোটর সাইকেলের তেলের খরচ দিয়েছে। আর আমার এসিসটেন্টকে দিয়েছে কুড়ি টাকা। এদের পয়সাকড়ি আছে।
আনিস বলল, চিকিৎসা কী করেছেন?
সাইফুদ্দিন সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন–চিকিৎসার কিছু নাই। আপনে যান। দেখলেই বুঝবেন। এখন একমাত্ৰ চিকিৎসা দোয়া দরুদ। একটা স্যালাইন দিতে পারলে ভালো হতো। গ্রামের মানুষ স্যালাইন দেয়াটা বড় চিকিৎসা মনে করে। স্যালাইন দিলাম না। দেড় দুই ঘণ্টা সময় দরকার। এর মধ্যে যদি রোগী মরে যায় আত্মীয়স্বজনরা বলবে ভুল চিকিৎসা করে মেরে ফেলেছি। কী দরকার?
রোগীর বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ আসছে। মেয়েরা কাঁদছে। বুঝাই যাচ্ছে রোগী মারা গেছে। গ্রাম অঞ্চলে মৃত্যুশোকের প্রাথমিক প্রকাশ অসম্ভব তীব্র। নিকটজনরা মাটিতে গড়াগড়ি করতে করতে বুকফাটা আর্তনাদ করতে থাকেন।
আনিস থমকে দাঁড়িয়ে গেল। এই অবস্থায় রোগীর বাড়িতে না ঢোকাই ভালো। আনিস পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করল। তার সিগারেট খাবার অভ্যাস ছিল না। গ্রামে এসে এই অভ্যাস হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে অভ্যাস তত বাড়ছে।
বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক লাঠিতে ভর দিয়ে এগুচ্ছেন। লুঙ্গি পরা খালি গা, কিন্তু তার এগিয়ে আসার ভঙ্গিতেই মনে হচ্ছে অতি প্ৰতাপশালী একজন। রোগীর দাদা বা এই স্থানীয় হবেন।
ডাক্তার সাব না?
জ্বি। আপনের অনেক সুনাম শুনেছি। আমার আফসোস আপনেরে এরা শেষ সময়ে এনেছে। আপনে গিয়া রোগীর কাছে বসেন। লোকজনরে বলতে পারব।–নাতির চিকিৎসার ক্রটি হয় নাই। তার মৃত্যুর সময়ও বড় একজন ডাক্তার তার বিছানার পাশে বসাইয়া রাখছিলাম।
আনিস হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দিয়ে বলল–চলুন।
মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব না। কিন্তু মৃত্যুকে সহনীয় করার চেষ্টা একজন ডাক্তারকে করতে হয়।
ঘর ভর্তি মানুষ। খাটের ওপর রোগী পড়ে আছে। নিঃশ্বাস নিতে তার ভয়ঙ্কর কষ্ট হচ্ছে। ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ট্রেসেকটামী করতে হবে। ফুসফুসে অক্সিজেন ঢোকার ব্যবস্থা করতে হবে। এখনি করতে হবে। দেরি করা যাবে না।
আনিস দ্রুত চিন্তা করছে–এলাৰ্জিক কোনো রিএকশান কি? মাঝে মাঝে এলাৰ্জি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
এলাৰ্জির কারণে শরীরে এভাবে পানি আসতে পারে না। কোনো সাইড এফেক্ট কি? শরীরের পানি বের করার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে সবার আগে যা দরকার তা হলো–ছেলেটার নিঃশ্বাস নেবার ব্যবস্থা করা। এলাৰ্জির চিকিৎসা করে শ্বাসনালির ফোলাটা একটু যদি কমানো যায়। শেষ চেষ্টা ট্রেসেকটামী। ইশ যদি অক্সিজেনের বোতল থাকত!
আনিস বলল, ঘর খালি করে দিন। গরম পানি দিন। একটা বড় চামুচ আনুন।
আনিস তার ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছে। তার মনে হচ্ছে স্কুলের স্পোর্টস হচ্ছে। একশ মিটার দৌড়ে সে নাম দিয়েছে। রেফারি হুইসেল দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্ৰাণপণে দৌড়াতে হবে। তার সঙ্গে যে দৌড়াবে তার নাম মৃত্যু। দৌড়ে মৃত্যুকে হারাতে হবে।
একজন মহিলা গরুর মতো বড় বড় চোখে আনিসের দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু পর পর তিনি কেঁপে কেঁপে উঠছেন। ডাক্তারের মনে হলো উনি ছেলের মা। অসংখ্য মহিলার মধ্যেও রোগীর মা’কে সব সময় আলাদা করা যায়।
আনিস মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি রোগীর গলায় ফুটো করব। ভয় পাবেন না। এ ছাড়া অন্য উপায় নেই।
মহিলা পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
দুই ঘন্টার মতো সময় পার হয়েছে।
রোগীর দাদা উঠোনে জলচৌকিতে বসে তামাক খাচ্ছিলেন। তাঁকে একজন দৌড়ে এসে বলল, কাদের ভালো আছে। শ্বাস কষ্ট কমেছে। পানি খাইতে চায়।
বৃদ্ধ বললেন, ডাক্তার সাব কী করতেছে?
উনি সিগারেট ধরাইছেন। বারান্দাত খাড়াইয়া সিগারেট খাইতেছেন।
বৃদ্ধ বললেন, আমারে অজুর পানি দেও। অজু কইরা দুই রাকাত শোকরানা নামাজ পড়বা। দুইটা গরু জবেহ কইরা মেহমানি দেও, আমার মানত ছিল। আরেকটা কথা, ডাক্তার সাবরে ভিজিটের টাকা দিবা না। এইটাতে উনার অপমান হবে। বৌমারে বল ডাক্তারের পা ছুঁইয়া যেন সালাম করে।
বৃদ্ধ হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলেন।
নবনী, কখন এসেছ?
নবনী বই হাতে উঠে দাঁড়াল। প্রশ্নের জবাব দিল না। কিছু প্রশ্ন আছে–জবাব দিতে হয় না। প্রশ্নকর্তা জবাব পাবার আশায় প্রশ্ন করেন না। আনিসের এই প্রশ্নটাও সেই গোত্রের। জবাব দিলে ক্ষতি নেই, না দিলেও ক্ষতি নেই।