বলতে পারছি না।
আজিজ মিয়া আসে নাই। খবর নিয়েছি সে গিয়েছে গৌরীপুর। গৌরীপুর কেন গিয়েছে জান?
জ্বি না।
আড়ং-এর জন্যে ষাঁড়। কিনতে গিয়েছে। আমার সাথে পাল্লা দিতে চায়। আমি ষাঁড় কিনেছি তারও ষাঁড় কিনা লাগবে। দেখি সে কি ষাঁড় কিনে।
জহির খাঁ আরেকটা পান মুখে দিলেন।
ইমাম সাহেবের কবর হলো তার পরদিন সন্ধ্যায়। কবর ঠিক না, গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেওয়া। মধ্যনগর গ্রামের হুজুর ফতোয়া দিলেন–অপঘাতে মৃত্যুর জানাজার বিধান নাই। লাশ কবরে নামানোর সময় অনেকেই চোখের পানি ফেলে। ইমাম সাহেবের ক্ষেত্রে শুধু মতি ভেউ ভেউ করে কিছুক্ষণ কাঁদল। গাঁজার নেশার কারণে ঘটনোটা ঘটল। ছয় পুরিয়া শেষ হবার পর সে আরো চারটা পুরিয়া এনেছে। এবারে দাম বেশি পড়েছে। চার পুরিয়ার জন্যে পঞ্চাশ টাকা দিতে হয়েছে। টাকাটা সে পেয়েছে ইমাম সাহেবের তোষকের নিচে।
ট্রেন দুঘণ্টা লেট
ট্রেন দুঘণ্টা লেট।
পৌঁছার কথা চারটায়, পৌঁছল ছটায়। নবনীর খুব বিরক্তি লাগছিল। তার ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট। কামরায় আর যারা আছে তাদের মনে হচ্ছে কারোরই টিকিট নেই। একজন আবার উঠেছে ছাগল নিয়ে। ট্রেনের বাথরুমের দরজা বন্ধ হয় না। মাঝে মাঝে এমন শব্দ হয় মনে হয়। দরজা ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। যতই সময় যাচ্ছে ততই তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। মেজাজ খারাপের চূড়ান্ত পর্যায়ে ট্রেন থামল। নবনী ট্রেনের জানোলা দিয়ে মাথা বের করে হঠাৎ করেই মুগ্ধ হয়ে গেল–কী সুন্দর দিন! পিচকারি ভর্তি হলুদ রঙ কেউ যেন বাতাসে ছিটিয়ে দিচ্ছে। আকাশের মেঘ। সূর্যের আলোকে কিছু একটা করেছে। দিনের শেষে আলো যেখানেই পড়ছে সোনা রঙ হয়ে যাচ্ছে। রঙের গান্ধ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। নবনীর মন খারাপ হলো এই ভেবে যে তার সঙ্গে কেউ নেই। কেউ থাকলে কিশোরীদের মতো চেঁচিয়ে বলতে পারত–দেখ দেখা কী সুন্দর! সুন্দর কিছু দেখলেই অন্যকে দেখাতে ইচ্ছা করে।
আরে আরো আফা না?
নবনী তাকাল। প্লাটফরম থেকে দৌড়ে তার দিকে কে যেন আসছে। গোলগাল মুখ, মাথা পরিষ্কার করে কামানো। মনে হচ্ছে আজই কামিয়েছেচকচক করছে। পরনে লুঙ্গি, পায়ে রবারের জুতা। গায়ে ইস্ত্রি করা টি-শার্টে লেখা University of California. লোকটি দাঁত বের করে এমনভাবে হাসছে। যেন নবনী তার দীর্ঘদিনের পরিচিত, অথচ নবনী আজই মানুষটাকে প্রথম দেখছে।
আফা আমারে চিনেছেন? আমি মতি। আপনি যান কই?
এখানেই নামব।
নামলে নামেন। জানোলা দিয়া বেদিশার মতো চাইয়া আছেন। আমি ভাবি ঘটনা। কী? আমরার আফা যায় কই? ট্রেন ছাইড়া দিব আফা।
আমি কিন্তু তোমাকে চিনতে পারছি না।
মতি আনন্দিত গলায় বলল, মাথা কামাইছি বইল্যা চিনতে পারতেছেন না। মাথায় উকুন হইছিল। মাথা কামাইয়া সোডার পানি দিয়া ধুইয়া উকুনের বংশ শেষ করছি। আফনে মনে হয় এখনো চিনেন নাই। ইয়াদ কইরা দেখেন প্ৰথমবার যখন আসছেন ডাক্তার সাবের কাছে আপনেরে কে নিয়া গেছিল?
ও আচ্ছা। মনে পড়েছে। তখন তোমার গাল ভর্তি দাড়ি ছিল।
এই তো চিনেছেন। দাড়িতেও উকুন হয়েছিল। উকুন আমারে ভালো পায়। নামেন আফা, নামেন। জিনিসপত্র কী আছে দেখায়ে দেন।
মতি লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ল। তাড়াহুড়া করার প্রয়োজন নেই। আজ ট্রেন ফাঁকা। মতি তার অভিজ্ঞতায় দেখেছে ট্রেন যখন ফাঁকা থাকে যাত্রীরা ধীরে সুস্থে নামে তখনই জিনিসপত্র ফেলে যায়। প্রচণ্ড ভিড়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটে না।
আফা আপনে যে আসবেন ডাক্তার সাব জানে?
আসব যে জানে। কবে আসব জানে না।
মতি চিন্তিত মুখে বলল, ঘরে বাজার আছে কি-না কে জানে! গিয়া হয়তো দেখবেন দুইটা আলু একটা পিয়াজ ছাড়া কিছু নাই। মহা চিন্তার বিষয় হইল।
নবনী বলল, মতি তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি দেখে শুনে মালগুলো নামাও। ঐ প্যাকেটে বই আছে। প্রচণ্ড ভারি, সাবধানে নামাও।
আফা আপনে নিশ্চিন্ত মনে নিচে গিয়া বসেন। আমার দেখা পাইছেন আর চিন্তা নাই।
নবনী ট্রেন থেকে নামল। পিচকিরি দিয়ে হলুদ রঙ ছোড়ার ব্যাপারটা এখনো ঘটছে। রঙ আরো গাঢ় হচ্ছে। তার কাছেই এ রকম লাগছে, না। অন্য সবার কাছেই লাগছে সে বুঝতে পারছে না। ট্রেন থেকে যারা নামছে তাদের কাউকেই মুগ্ধ চোখে এদিক ওদিক তাকাতে দেখা যাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ যদি ট্রেনে তার সঙ্গে আসতেন তাহলে কী করতেন? চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতেন? হাত বাড়িয়ে হলুদ আলো ছোয়ার চেষ্টা করতেন? প্লাটফরমে নেমে সুটকেসের ওপর বসে কাগজ কলম নিয়ে গান কিংবা কবিতা লিখতে বসতেন?
‘আলো ভাঙ্গার এই আলো।’
রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই ‘কী সুন্দর! কী সুন্দর!’ বলে উচ্ছাস প্রকাশ করতেন না। এত বড় মানুষদের উচ্ছাস মানায় না। তীব্ৰ উচ্ছাস কিশোরীদের এলাকা। কিশোরীদের এলাকায় কিশোরীদেরই মানায় অন্য কাউকে মানায় না। হাতের তালুতে তেতুলের আচার নিয়ে যখন কোনো কিশোরী চোটে চেটে খাবে তাকে মানাবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মানাবে না।
আফা দেখেন জিনিস সব নামছে কিনা।
নেমেছে, থ্যাংক য়ু। এখন একটা ভ্যানগাড়ি দেখ। চল রওনা দেই। এর আগের বার তুমিই তো আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলে?
অবশ্যই আমি। হেইবার আফনের পরনে ছিল কচুয়া রঙের শাড়ি, লাল সুতার হিজিবিজি পাইর।
ঠিকই বলেছ, মতি শোন আমরা দেরি করছি কেন?
পাঁচ দশ মিনিট বসতে হইব আফা।
বসতে হবে কেন?
সইন্ধ্যা মিলাইতাছে তো, এই সময় যাত্ৰা নাস্তি। সইন্ধ্যা মিলাউক। ফ্লাস্কটা দেন–গরম পানি আইন্যা দেই। চা বানায়ে খান। আপনের সঙ্গে চায়ের সরঞ্জাম আছে না আফা? গতবার ছিল।