মতি হাত কচলে খুবই বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ডাক্তার সােব কেমন আছেন
ভালো আছি।
কেমন প্ৰলয় ঘটনা ঘটেছে দেখলেন? আর একটু হলে কিয়ামত হয়ে যেত।
হুঁ।
বাপের জন্মে এই জিনিস দেখি নাই। বটগাছ উড়ায়ে নিয়ে গেছে। বটগাছের কাছে ইয়াছিন মিয়া বইস্যা হুক্কা টানতেছিল। তার কল্কির আগুন পর্যন্ত নিভে নাই। সে এমন ভয় খাইছে। কাপড় নষ্ট করে ফেলেছে। ছোট নষ্ট না, বড় নষ্ট। লুঙ্গি বরবাদ কেমন আচানক ঘটনা বলেন দেখি?
খুব আচানক না। টর্নেডোতে এমন হয়।
কী কন আপনে?
টর্নেডোর ঠিক মাঝখানে থাকে। টর্নেডোর চোখ। এই চোখ যে সব জায়গা দিয়ে যায় তার ব্যাপক ক্ষতি করে। কিন্তু আশেপাশে তেমন কিছু হয় না।
পুস্কুনির সব মাছ ভাইস্যা উঠছে–খবর পাইছেন?
সেটাই দেখতে এসেছিলাম। ইন্টারেষ্টিং তো বটেই। এই জিনিস। আমি নিজেও আগে কখনো দেখি নি।
মতি গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, এটা আর কিছু না। এটা আল্লাপাকের ঘণ্টা। আল্লাপাক ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি দিয়া আমাদের বলেছেন–বান্দা, সাবধান হও।
আনিস কিছু বলল না। সাইকেল টেনে এগুতে লাগল। তার পেছনে পেছনে আসছে মতি। এটা মোটামুটি একটা দুর্ঘটনা। মতি কথা না বলে থাকতে পারে না। হড়বড় করে কথা সে বলতেই থাকবে। মতির বয়স ত্ৰিশ। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা। বিরাটনগরে তার একটা চালাঘর আছে। তবু রাতে সে ঘুমায় নান্দাইল রোড ইষ্টিশনে। একই সঙ্গে সে নানান কাজকর্ম করে, আবার কিছুই করে না। মাঝে মধ্যে কুলির কাজ করে। যাত্রীদের মালামাল নামায়। কিছুদিন গ্রামে এসে থাকে। ঘরামীর কাজ করে। শীতের সিজনে মুড়ি লাড়ু বানিয়ে ট্রেনে করে বিক্রি করতে চলে যায়–গৌরীপুরমোহনগঞ্জ। কিছুদিন হলো–সে জুরের একটা বড়ি বানানোর চেষ্টা করছে। লালু ফকিরের কাছ থেকে ফর্মুলা জোগাড় হয়েছে। ফর্মুলা মতো বড়ি বানিয়ে রোদে শুকাতে দেবার সময় গণ্ডগোলটা হচ্ছে। একটু শুকালেই বড়ি পাউডারের মতো হয়ে যাচ্ছে। বড়ির নামও মোটামুটি ঠিক করা–
‘জ্বরমতি’
নিজের নামটা কায়দা করে বড়ির নামের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া। যতদিন এই বাড়ি থাকবে ততদিন মতির নামও থাকবে। এটা কম কথা না।
বড়ি বানানো হয়ে গেলে হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে গৌরীপুর, নেত্রকোনা, শ্যামগঞ্জ এই লাইনে বিক্রি করতে হবে। এই অঞ্চলের লোকদের পেটের ব্যথা বেশি– ট্যাবলেটে চোখের নিমিষে উড়ে যাবে। বিজ্ঞাপনের ভাষাও মোটামুটি ঠিকঠাক–
আসিয়াছে! আসিয়াছে!!
জ্বর নাশক ‘জ্বরমতি’ বাড়ি।
এক বড়ি যেমন তেমন
দুই বাড়িতে কাম
ভাই ব্রোদার শুনেন শুনেন
জ্বরমতির নাম।
এই বড়ি স্বপ্নে প্রাপ্ত। বড়ির ক্রয় বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
শুধু হাদিয়া বাবদ পাঁচ টাকা।
বড়ি সেবনের পরের সাত দিন গোমাংস ভক্ষণ এবং
স্ত্রী সহবাস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
গ্যারেন্টিসহ চিকিৎসা। বিফলে সম্পূর্ণ মূল্য ফেরত।
মতির ইচ্ছা বড়ির বিষয়টা নিয়ে ডাক্তার সাহেবের সাথে কথা বলে। ডাক্তার সাহেব অতি জ্ঞানী মানুষ, তিনি সমস্যার সমাধান জানবেন। বড়িগুলো পাউডার হয়ে যাচ্ছে কেন এটা তিনি কি আর জানবেন না। ডাক্তার মানুষ তাদের কাজ কারবার হলো বড়ি নিয়ে।
ডাক্তার সাব।
হুঁ।
মতি চিন্তিত মুখে ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকাল। সে সামান্য হতাশ বোধ করছে। ডাক্তার সাহেব হুঁ বলা শুরু করেছেন। ডাক্তার সাহেবের এই এক অভ্যাস। একবার হুঁ বলা শুরু করলে–হুঁ বলতেই থাকেন। যাই জিজ্ঞেস করা হোক, উত্তর একটাই– হুঁ।
বড়ই আচানক ঝড় হয়েছে। কি বলেন?
হুঁ।
পাখি মারা পড়েছে বেশুমার। সব ধরনের পাখি মারা পড়েছে। এর মধ্যে একটা ডাহুক পাখিও দেখলাম।
হুঁ।
ডাহুক পাখির মাংস অতি স্বাদু।
হুঁ।
আপনি ডাহুক পাখির মাংস কোনোদিন খেয়েছেন?
না। খাই নি।
মতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ডাক্তার সাহেব হুঁ বলা বন্ধ করেছেন। এখন হয়তো কিছু কথাবার্তা বলবেন।
ডাহুক পাখি। বছরে একদিন অন্ধ হয়ে যায়–এটা জানেন?
না।
খুবই আচানক ঘটনা। বছরে একদিন ডাহুক পাখি চোখে দেখে না। ডাহুক পাখি ধরার এই একটাই সুযোগ। ঐ দিনেই ধরা হয়।
ডাক্তার কৌতূহল চোখে তাকাল। একটি বিশেষ শ্রেণীর পাখি বৎসরে একদিন চোখে দেখে না–এটাতো বিস্ময়কর ঘটনা। ঘটনার পেছনে কি সত্যতা আছে? না-কি এটিও অনেক লোকজ বিশ্বাসের মতো একটি অপরীক্ষিত লোকজ বিশ্বাস?
ডাক্তার সাব।
বল।
ঝড়ে যেসব পাখি মারা গেছে সেইগুলা খাওয়া কি জায়েজ আছে?
তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
ধরেন একটা ডাহুক পাখি গাছের আগায় বসে আছে। ছররা গুলি দিয়া তারে মারলাম। এই পাখি খাওয়া জায়েজ আছে। আবার ধরেন ঝড়ে পাখিটা মারা গেলে–সেটা খাওয়া কি জায়েজ আছে?
আমি বলতে পারছি না। তবে আমি কোনো সমস্যা দেখি না।
খাবেন?
ডাক্তার বিস্মিত হয়ে বলল, কী খাব?
মতি ইতস্তত করে বলল, বাঁশ ঝাড়ের নিচে একটা ডাহুক পাখি মরে পড়ে আছে। বেশি করে পিয়াজ রসুন দিয়ে ঝালকাল করে রোধে নিয়ে আসি? খান। আপনে ডাহুক পাখির মাংস খান নাই। খেলে মজা পাবেন। পাখির মাংস শক্ত হয়। ডাহুক পাখির মাংস মোলায়েম। হাড্ডি সুন্দা মুখের মধ্যে গলে যায়। যদি খান–ব্যবস্থা করি।
না। ডাহুক পাখি খাব না।
আমার কথায় রাগ হয়েছেন?
না, রাগ হই নি। রাগ হব কেন?
রাগ হয়ে থাকলে নিজগুণে ক্ষমা করবেন। এতবড় একটা বড় নিজের চউক্ষে দেখার পর থাইক্যা মাথা ঠিক নাই। কী বলতে কী বলি।
ডাক্তার জবাব না দিয়ে সাইকেলে উঠে পড়ল। মতি ফিরে চলল বাঁশ ঝাড়ের কাছে। ডাহুক পাখিটার একটা ব্যবস্থা করতে হয়। নান্দাইল রোড ৰাজারের একটা মেয়ে মানুষের কাছে তার যাতায়াত আছে। মেয়ে মানুষটার নাম মর্জিনা। এই মেয়ের খাওয়া খাদ্য খুব পছন্দ। সবসময় তার মুখে কিছু না কিছু আছে। মুখ নড়ছেই-টুকুর টুকুর টুকুর। এক বাটি পাখির মাংস রোধে নিয়ে গেলে মার্জিনা বড়ই খুশি হবে। তুফানের গল্পটাও করা দরকার। সামান্য জোড়াতালি দিয়ে সুন্দর করে বলতে হবে। আচানক ঘটনা শুনতে পুরুষ মানুষ তেমন পছন্দ করে না, মেয়ে মানুষ করে। ঝড়ের ঘটনা মতি কীভাবে বলবে মনে মনে গুছাতে শুরু করল–