হেলিকপ্টারের উত্তেজনার পাশে ইমাম সাহেবের মৃত্যু তেমন কিছু না। পর পর দুটি উত্তেজনা মানুষ নিতে পারে না। বড় ধরনের একটি উত্তেজনাতেই মানুষ ঝিমিয়ে পড়ে। এ রকম ঝিমিয়ে পড়া অবস্থায় ইমাম সাহেবের লাশ নিয়ে নাটক শুরু হলো। মন্ত্রী চলে যাবার পর রোয়াইল বাজার থানার ওসি কিছু হস্থিতম্বি করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, ডেডবডি দেখে তার মনে হচ্ছে না। আত্মহত্যা। কেউ খুন করে ঝুলিয়ে রেখেছে। কঠিন তদন্ত হবে। তদন্তে রুই কাতলা বের হয়ে পড়তে পারে। প্রয়োজনে আসল খবর বের করার জন্যে থানায় নিয়ে ট্ৰিটমেন্ট দেয়া হবে। হন্বিতান্বিতে তেমন কাজ হলো না। জহির খাঁ ওসিকে ডেকে বললেন, খামাখা প্যাচাল করবা না। সুরতহাল টাল কী করতে হয় ব্যবস্থা কর। ডেডবডি মধুপুর পাঠায়ে দিতে হবে।
ওসি সাহেব ধমক খেয়ে মিইয়ে গেলেন। ধমক এমন লোকের কাছ থেকে এসেছে যার বাড়িতে মন্ত্রী কিছুক্ষণ আগে খাওয়া দাওয়া করেছেন। হেলিকপ্টারে ওঠার আগে আগে কোলাকুলি করেছেন। যে সব মৃত্যু অর্থকরী না, পুলিশ সেসব মৃত্যুর বিষয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। পুলিশ উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। ওসি সাহেব বিমর্ষ মুখে বললেন–সুরতহালের জন্যে ডেডবডি নেয়ার ব্যবস্থা করছি। থানা থেকে ভ্যানগাড়ি আসবে। আত্মীয়স্বজন কেউ যেন যায়। সুরতহালের ফিস আছে। হাজার দুই টাকা যেন সাথে নেয়।
পুলিশের ভ্যান সে রাতে এসে পৌঁছোল না।
মতি সারারাত ইমাম সাহেবের পাশে রইল। রাত ন’টা দশটা পর্যন্ত তার সঙ্গে লোকজন ছিল–একে একে সবাই বিদায় হয়ে গেল। মরা মানুষ ফেলে রেখে গেলে শিয়াল-কুকুর খেয়ে ফেলবে। মতির বিরক্তির সীমা রইল না। অন্যদের মতো সেও কেন চলে গেল না? এ রকম বোকামিটা করল কীভাবে? তার একমাত্র ভরসা সঙ্গে গাজা ভরা সিগারেট আছে। গাজার ধোয়ায় টান দিয়ে যে-কোনো পরিস্থিতি পার করে দেয়া যায়। সমস্যা একটাই খালিপেটে থাকলে চলবে না। পেট ভর্তি থাকতে হবে।
ইমাম সাহেবের লাশ। তার ঘরের চৌকির ওপর রাখা আছে। কম্বল দিয়ে লাশটা ঢাকা। গন্ধ সহজে বের হবে না। মতি বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করে। দিয়েছে। শিয়াল কুকুরের ঘরে ঢোকার পথ বন্ধ। সে বসে আছে। উঠানে। উঠানের দু’মাথায় দুটা হারিকেন জ্বালিয়েছে। অগ্নিবন্ধন। জিন, ভূতের দুই দিক থেকেই আসা বন্ধ।
মতি এক ফাঁকে ইমাম সাহেবের রান্নাঘরও দেখে এসেছে। চাল আছে, ডাল আছে, পিয়াজ রসুন আছে। তেলের শিশিতে তেলও আছে। ক্ষিধাটা ভালোমতো লাগলে চাল ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি বসিয়ে দিতে হবে। পেট ভরা থাকলে ভয় কম লাগে। সঙ্গে গাঁজার সিগারেট আছে ছয়টা। একেকটার দাম পড়েছে দশ টাকা করে। ছটা ষাট টাকা। মতি মূলমূলি করে পঞ্চাশ টাকায় কিনেছে। এইসব হলো আরাম করে খাওয়ার জিনিস। তার এমনই কপাল মারা লাশের পাশে বসে সব কটা পুরিয়া শেষ করতে হবে। বেহুদা পঞ্চাশ টাকা চলে গেল।
প্রথম গাঁজার পুরিয়া খেয়ে মতির দুঃখবোধ কেটে গেল। মায়াবোধ প্রবল হলো। তার কাছে মনে হলো–ইমাম সাহেব আহারে বেচারা! মরে পড়ে আছে। নিকট-আত্মীয় পর-আত্মীয় কেউ নেই। ইমাম সাহেবের মতো একজন নামাজি ভালো মানুষের পাশে কে আছে? আছে মতির মতো দুষ্টলোক। যে ঈদের নামাজ ছাড়া অন্য কোনো নামাজে সামিল হয় না। মাঝে মধ্যে তওবা করে পাপমুক্ত অবশ্যি হয়। সে অবশ্যি বুঝে, তওবাটা করে সে আল্লাহপাককে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে। মতির ধারণা আল্লাহপাকও ব্যাপারটা বুঝেন, তবে বুঝেও চুপ করে থাকেন। এই জন্যেই তিনি রহমানুর রহিম।
মৃত্যুর পর মতির কঠিন শাস্তি হবে এটা সে জানে। যে পড়ে থাকে বাজারের মেয়েছেলের বাড়িতে তাকে আল্লাহপাক আদর করে বলবেন–‘ওরে মতি যা বেহেশতে ঢোক। তাম্বুর নিচে হরপরী আছে। যারে যারে পছন্দ হয় সাথে নিয়া সরুবান তহুরা খা। যত ইচ্ছা খা।’ তা হবে না। আগুনে তাকে পুড়তেই হবে। দু একটা ভালো কাজ সে যে করে নাই তা-না। করেছে। তবে খারাপ কাজের তুলনায় ভালো কাজ এতই নগণ্য যে দোজখের আগুন থেকে সেই পুণ্য তার একটা কেনি আংগুলও বাচাতে পারবে না।
এই যে ইমাম সাহেবকে সে পাহারা দিচ্ছে এটা তো একটা ভালো কাজ। কারণ লোকটা ভালো। চেয়ারম্যান সাব লোকটাকে কানো ধরে চক্কর দেয়ায়েছেন–অন্যায় করেছেন। নির্দোষ লোকের শাস্তি হয়েছে। দোষীও হইতে পারে। মানুষ চেনা বড় কঠিন। সবাই তাকে ভালো মানুষ জানে, আসলে সে বিরাট চোর। মরজিনার নাকফুল চুরি করে কুড়ি টাকায় বেচেছিল। অবশ্য এই টাকাটা সে জরিনার পেছনেই খরচ করেছে। আধা কেজি গরম জিলাপি কিনে খাইয়েছে। নিজে একটাও খায় নি।
হাসানকে জিজ্ঞেস করলে জানা যায়।
হাসান নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলবে না। তবে হাসানকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে না। যদি হাসান বলে ঘটনা সত্য তখন কী হবে? মৃত মানুষের খারাপ কিছু নিয়ে আলোচনা করতে নাই। মৃত মানুষকে নিয়ে ভালো ভালো কথা বলতে হয়। এটাই নিয়ম। মতি মরে গেলে কেউ কি তাকে নিয়ে একটা ভালো কথা বলবে। মনে হয় না।
মতি দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরাল। জিনিস খারাপ দেয় নাই–এক নম্বর জিনিসই দিয়েছে। মনে ফুর্তির ভাব আসি আসি করছে–হয়তো এসেও যাবে। জস্পেশা খিদে জানান দিচ্ছে। এক ফাঁকে খিচুড়ি বসায়ে দিতে হবে। ডিম পাওয়া গেলে ভালো হতো। একটা দুটা খিচুড়ির মধ্যে ছেড়ে দিলে স্বাদ যা হয় তার কোনো তুলনা নাই। তেতুল গাছের নিচে খচমচ শব্দ হচ্ছে। মতি কৌতূহলী হয়ে তাকাচ্ছে। সাধারণ অবস্থায় থাকলে ভয় লাগত। এখন সে সাধারণ অবস্থায় না। শিয়াল-টিয়াল হবে। মরা মানুষের গন্ধ পেয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছে। হাতের কাছে একটা লাঠি রাখা দরকার। শিয়ালের পাল মারা মানুষ একবার খেতে শুরু করলে আধাপাগল হয়ে যায়, তখন জীবিত মানুষ খেতে চায়। ঘরের ভেতরও খচমচ শব্দ হচ্ছে। বেড়া ভেঙে কোনো শিয়াল কি ভিতরে ঢুকে পড়েছে? ঢুকে পড়লে কিছু করার নাই। খাওয়া দাওয়া করে যা থাকে তাই কবরে ঢুকিয়ে দিতে হবে। মতি আরেকটা সিগারেট ধরাল। মৌতাতটা মোটামুটি জমছে। মনে ফুর্তির ভাব চলে এসেছে। এটা কিছুতেই নষ্ট হতে দেয়া যাবে না। মতি গুনগুন করে গান গাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। এই পরিস্থিতিতে ধমীয় গান গাইতে পারলে ভালো হতো। ‘চলো যাই মন্দিনা’ ধরনের গান। সে রকম গান একটাও মনে পড়ছে না। সে মাথা দুলাতে দুলাতে সিনেমার গান শুরু করল। এই সিনেমাটা সে মর্জিনাকে নিয়ে নেত্রকোনার হলে দেখে এসেছে। খুবই ট্রাজেডি সিনেমা। মতি উদাস গলায় গাইছে–