ডাক্তার সাব আপনার অনেক মেহেরবাণী।
মেহেরবানির কিছু না। আপনি বিশ্রাম করুন।
ইমাম সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, যে অপরাধের জন্যে আমার শাস্তি হয়েছে সেই অপরাধ আমি করি নাই। তবে নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ করেছি। যে কারণে আল্লাহপাকের নির্দেশে আমার শাস্তি হয়েছে। উনার অনুমতি ছাড়া কিছুই হয় না।
ডাক্তার বলল, আপনি কথা বলবেন না। বিশ্রাম করুন। আমি ওষুধ পাঠাচ্ছি।
ইমাম সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন। বিড়বিড় করে নিজের মনেই বললেন, ডাক্তার সােব আপনার মেহেরবানি।
ফেরার পথে মতি তিক্ত গলায় বলল, কেমন মানুষ দেখছেন ডাক্তার সাব? মুখে একবার বলল না–ধন্যবাদ। বমি সাফ করা আর গু সাফ করা একই। বমি পেটে আর কিছুক্ষণ থাকলেই গু হইয়া যায়–কথা সত্য কিনা বলেন ডাক্তার সাব।
আনিসা জবাব দিল না। ইমাম সাহেবের বাড়ি গ্রামের শেষ মাথায়। আনিসকে শরীরে জ্বর নিয়ে অনেকখানি হাঁটতে হয়েছে। বেশ খারাপ লাগছে। অসহ্য লাগছে মতির বকবকানি। আনিস মতিকে চলে যেতে বলতে পারছে না। কারণ মতিকে দিয়ে ওষুধ পাঠাতে হবে।
গরম কেমন পড়ছে দেখছেন ডাক্তার সাব?
হুঁ।
এখন আশ্বিন মাস–কেঁথা-শীত পড়নের কথা। পড়ছে। গরম। দুনিয়া উলট পালট হওয়া শুরু হইতেছে। কেয়ামত মনে হয় কাছাইয়া পড়ছে। কী কন?
হতে পারে।
মতি আগ্রহের সঙ্গে বলল, কেয়ামতের আগে আগে মাটির তল থাইক্যা এক জন্তু ৰাইর হইব। হে মানুষের মতো কথা বলব। এই জন্তুটা দেখার বড় শখ ছিল। দশ পনরো বছরের মধ্যে কিয়ামত হইলে জম্বুটা দেখতে পারতাম। জন্তুর সাথে দুই চাইরটা কথা বলতে পারতাম। ডাক্তার সােব আপনের কি মনে হয় দশ বছরের মধ্যে কিয়ামত হইতে পারে?
জানি না মতি।
জন্তুটা কোন ভাষায় কথা বলব কে জানে! চাইনীজ ভাষায় কথা বললে আমরা বাঙালিরা কিছুই বুঝব না।
মতি, কথা বলা একটু বন্ধ রাখ। মাথা ধরেছে।
আমার নিজেরো মাথা ধরছে ডাক্তার সাব এই জন্যেই কথা বেশি বলতেছি। আমি একটা জিনিস পরীক্ষা কইরা বাইর করছি–মাথায় যদি খুব যন্ত্রণা হয় তাইলে কথা বললে যন্ত্রণা কমে। আর কথা না বইল্যা ঘরের চিপাত বইস্যা থাকলে মাথা ধরা বেজায় বাড়ে।
এক গ্লাস দুধ, দুটা বিসকিট আর ওষুধ নিয়ে মতি রওনা হলো ইমাম সাহেবের বাড়ির দিকে। পথে কিছুক্ষণ দেরি হলো–ইষ্টিশনের চায়ের দোকানটা খোলা, মতি এক কাপ চা খেল। চা খাওয়া মানেই গল্পগুজব। গল্পগুজবেও কিছু সময় গেল। সেখান থেকে গেল বাতাসীর ঘরে। জেনে যাওয়া–ঐ লোকটা এখনো তার ঘরে আছে কি-না। থাকলেও কিছু যায় আসে না–না থাকলেও না। লোকটা তো আর বিনা পয়সায় থাকছে না। পয়সা দিয়ে থাকছে। লোকটা যদি চলে গিয়ে থাকে তাহলে বাতাসীর সঙ্গে এক কাপ চা খাওয়া যাবে। এই ভেবে সে পুরনো কোকের বোতল ভর্তি করে এক বোতল চা সঙ্গে নিয়ে নিল। বাতাসীর ঘরে লোক থাকলে কোকের বোতল নিয়ে ইমাম সাহেবের কাছে যাবে। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তাতে অসুবিধা নাই। ঠাণ্ড চা খেতে মতির খারাপ লাগে না। বরং ঠাণ্ডা। চা খেতেই তার বেশি ভালো লাগে।
এত সব করতে মতির অনেক দেরি হয়ে গেল। সে ইমাম সাহেবের বাড়ি পৌছাল রাত একটায়। আকাশে তখন কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। আবছা আবছা সব কিছু দেখা যায়। মতি হতভম্ব হয়ে দেখল। ইমাম সাহেবের বাড়ির ডান দিকের তেতুল গাছের নিচে কী যেন দাঁড়িয়ে আছে। মতি বলল–কেডা গো?
কেউ জবাব দিল না।
মতি বলল–কেডা? আপনে কে?
এই প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া গেল না।
মতি এগিয়ে গেল। তার জন্যে বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করছিল। তেতুল গাছের নিচে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল না। তেতুল গাছের ডাল থেকে ঝুলছিলেন ইমাম সাহেব। মতি অতি দ্রুত দা দিয়ে দড়ি কেটে তাকে নামাল। ইমাম সাহেব বিড় বিড় করে কী যেন বললেন, ঠিক বুঝা গেল না। মনে হলো–পানি খেতে চাইছেন। মতি ছুটে গেল পানি আনতে–তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইমাম সাহেব মারা গেলেন।
নিস্তরঙ্গ দিঘিতে ছোট্ট ঢিল
নিস্তরঙ্গ দিঘিতে ছোট্ট ঢিল পড়লেও অনেকক্ষণ ঢেউ ওঠে। সেই অর্থে ইমাম সাহেবের মৃত্যুতে বিরাটনগরে যে ঢেউ ওঠার কথা সেই ঢেউ উঠল না। ঐ দিনই কাকতালীয়ভাবে যোগাযোগ মন্ত্রী চলে এলেন। বিরাটনগর-রোয়াইলবাজার সড়কে মগরা নদীতে পুল হবে, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। আগে কয়েকবার তারিখ দিয়েও মন্ত্রী আসতে পারেন নি। এবারে তাই হুট করে চলে এসেছেন।
মন্ত্রীর আগমন বিশাল ঘটনা। সেই আগমন যদি হেলিকপ্টারের মতো বাহনে হয় তাহলে তো কথাই নেই। বিরাটনগরে যে আলোড়ন উঠল তার তুলনা নেই। বিশাল এক পক্ষী পাখা ঘুরাতে ঘুরাতে নামছে। তার শব্দে পৃথিবী কাঁপছে। বিরাটনগরের লোকজনের জন্যে তুলনাহীন অভিজ্ঞতা। মন্ত্রীর হেলিকপ্টার দুপুর বারটায় এসে পৌছল। তিনি ভিক্তিপ্ৰস্তর স্থাপন করে বিরাটনগর হাইস্কুলের মাঠে এক ভাষণ দিলেন। জনতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভাষণ শুনল। যোগাযোগ মন্ত্রীর যোগাযোগ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলার কথা না, যেহেতু স্কুলের মাঠে ভাষণের ব্যবস্থা সেহেতু তিনি শিক্ষার গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও কিছু কথা বললেন এবং স্কুল ফান্ডে নগদ দশ হাজার টাকা ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দান করলেন। গ্রামের মানুষজন তালি দিতে দিতে হাত ব্যথা করে ফেলল।
বক্তৃতা পর্বের শেষে চায়ের ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থা চেয়ারম্যান জহির খাঁর বাড়িতে। জহির খাঁ অতি অল্প সময়ের নোটিশে চা পানের বিপুল আয়োজন করে ফেললেন। এমন ব্যবস্থা যে মন্ত্রী পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলেন–প্রত্যন্ত গ্রামেও দেখি ভালো ব্যবস্থা করেছেন! আমি তো এ রকম আশাই করি নি। মন্ত্রী আশা করেন নি। এ রকম আরেকটি কাজ জহির খাঁ করলেন–গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে মন্ত্রীকে সোনার ঢেঁকি উপহার দিলেন। মন্ত্রীর প্রথমবার আসার তারিখেই জহির খাঁ ঢাকা থেকে পাঁচ ভরি সোনার ঢেঁকি বানিয়ে এনেছিলেন। সেটা শুধু যে কাজে লাগল তা না। অনেকখানি কাজে লাগল। মন্ত্রী তিনবার বললেন—বাহ জিনিসটা সুন্দর তো। শুধু যে সুন্দর তা-না, টেকি শাশ্বত বাংলার প্রতীক। সাধারণত মন্ত্রী শ্রেণীর কাউকে কোনো উপহার দিলে সেই উপহার বেশিক্ষণ হাতে রাখা নিয়ম না। ছবি তোলা হয়ে গেলেই উপহার অন্য কারোর হাতে তুলে দেয়া হয়। সোনার ঢেঁকির ক্ষেত্রে সে রকম হলো না। ফটোগ্রাফারের ছবি তোলার পরও মন্ত্রী উপহার হাতে বসে রইলেন। হেলিকপ্টারে ওঠার সময়ও তার হাতে উপহারটা দেখা গেল।