না তো।
একটা চক্করের পরেই ঠাশ কইরা মাথা ঘুইরা পইড়া গেল।
আনিস অবাক হয়ে বলল, তোমার কথা বুঝলাম না–কীসের চক্কর?
মতি তার চেয়েও অবাক হয়ে বলল, ইমাম সাবরে যে আইজ লেংটা কইরা চক্কর দেয়া হইছে আপনে জানেন না?
না, জানি না।
বাদ আছর চক্কর দেয়ানি হইল। বিরাট জনতা। মনে হইতেছিল ষাঁড়ের আড়ং।
আনিস হতাশ গলায় বলল, চেয়ারম্যান সাহেব শেষ পর্যন্ত এই কাজটা করলেন?
মতি বলল, করব না। আপনে কী কন? আমরার চেয়ারম্যান সাব এক কথার মানুষ। বাক্কা বেডার চাক্কা। হে যদি বলে আমি বাঘের দুধ খামু তাইলে আপনে নিশ্চিন্ত থাকবেন বাঘের দুধ আসতাছে। সুন্দরবন থাইক্যা বাঘ আইব, হেই বাঘ পানানি হইব–হেই দুধ জামবাটির এক বাটি চেয়ারম্যান সাব নিয়া খাইব।
মতি তুমি বুঝতে পারিছ না। কাজটা খুবই অন্যায় হয়েছে।
আপনের কাছে অন্যায়, কিন্তুক গ্রামের আর দশটা লোকের কাছে ন্যায়। যেমন ধরেন–আপনের সাইকেল চুরি হইছে। আপনার কাছে মনে হইছে কাজটা অন্যায়। কিন্তু যে চুরি করছে তার কাছে কাজটা ন্যায়।
আনিস শার্ট গায়ে দিল। লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরতে শুরু করল। মতি অবাক হয়ে বলল, শইল খারাপ নিয়া যান কই?
ইমাম সাহেবকে দেখে আসি।
চলেন যাই। ওষুধের বাক্স সাথে নেন। শুনছি ইমাম সাহেবের অবস্থা ভালো না। ক্ষণে ক্ষণে বমি হইতেছে।
আনিসের খুব খারাপ লাগছে। শুধু খারাপ না রাগও লাগছে। বিরাটনগরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে এইসব নিয়ে তার কখনো মাথাব্যথা ছিল না। যা ইচ্ছা হোক। সে ডাক্তার মানুষ, সে রোগের নিদান দেবে। এর বেশি কিছু না। সে রোগ চিনবে, যে মানুষটাকে রোগে ধরেছে তাকে তার চেনার দরকার নেই। বেচারা ইমাম সাহেবের জন্যে তার এই মুহূর্তে যে মায়াটা হচ্ছে তার কারণটা আনিসের কাছে স্পষ্ট না। ইমাম সাহেব তার খুব যে পরিচিত কেউ তা না। ভাসা ভাসা পরিচয়। হঠাৎ দেখা হলে অল্প কিছু কথা। এই মানুষটা মসজিদ এবং মসজিদের পাশে ছোট্ট চালাঘর নিয়ে একা থাকেন। ভদ্রলোকের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বাতিক আছে। সারাক্ষণই তাকে দেখা যায় হয় মসজিদ পরিষ্কার করছেন নয়তো নিজের বাড়ি পরিষ্কার করছেন। উঠান ঝাঁট দিচ্ছেন, বাড়ির সামনের আগাছা তুলছেন। তিনি মসজিদের চার কোণায় চারটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ লাগিয়েছেন। এই
গাছ চারটার প্রতি তার মমতা অসীম। কারো সঙ্গে কথা হলেই, কৃষ্ণচূড়া গাছের প্ৰসঙ্গ চলে আসে।
নবনী যখন বিরাটনগরে এসেছিল তখন ইমাম সাহেব বেশ কিছু পাকা তেতুল নিয়ে নবনীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তার বাড়ির দক্ষিণদিকে তেতুলগাছে খুব তেতুল হয়। ইমাম সাহেব বিনীত ভঙ্গিতে নবনীকে বলেছিলেন–আপনার স্বামীর এই অঞ্চলে ভালো চিকিৎসক হিসেবে খুবই সুনাম। উনাকে কিছু উপহার দিব এই সামর্থ আমার নাই। আপনার জন্যে কিছু পাকা তেতুল আনলাম। আমার গাছে হয়েছে। নবনী বলেছিল–গাছ থেকে পেড়ে এনেছেন?
জ্বি।
গাছে কি এখনো তেতুল ঝুলছে?
জ্বি।
এইগুলো আপনি নিয়ে যান। আমি গাছে উঠে নিজের হাতে পাকা তেতুল পাড়ব।
ইমাম সাহেব খুবই লজ্জিত গলায় বলেছেন–এটা সম্ভব না। মসজিদের কাছে গাছ। সেই গাছে মেয়েছেলে উঠে তেতুল পাড়বে–এটা ঠিক না।
নবনী তেজি গলায় বলেছিল, ঠিক না কেন? আল্লাহ রাগ করবেন?
তার উত্তরে ইমাম সাহেব বলেছেন, আল্লাহপাক এত সহজে রাগ করেন। না। কিন্তু মানুষ রাগ করে। আমরা এমন যে মানুষের রাগটাকেই বেশি ভয় পাই।
ইমাম সাহেবের ঘরে হারিকেন জ্বলছে। তিনি মেঝেতে পাটির ওপর কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছেন। শীতল পাটি বমিতে মাখামাখি। তিনি বমির মধ্যেই শুয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছেন। তার মনে হয়৷ এজমা আছে। যতবারই নিঃশ্বাস নিচ্ছেন বুকের ভেতর থেকে শো শো শব্দ আসছে। ঘরে কটু গন্ধ।
মতি বলল, ইমাম সাব জাগনা আছেন? ডাক্তার সাব আসছেন।
ইমাম সাহেব মাথা তুলে তাকালেন। আবার মাথা নামিয়ে ফেললেন। তাকে দেখে মনে হলো না। তিনি কাউকে চিনতে পেরেছেন।
আনিস বলল, মতি উনাকে গোসল দেয়া দরকার। গোসল করাতে পারবে?
মতি বলল, আপনে বললে পারব।
আনিস বলল, বালতিতে করে পানি আন। সাবান আন। দুজনে মিলে গোসল দিয়ে দেই।
মতি বলল, আপনার এত ঠেকা কী ডাক্তার সাব!
ডাক্তার বিরক্ত গলায় বলল, সে একজন রোগী। এই জন্যেই আমার ঠেকা।
মতি ডাক্তারকে হাত দিতে দিল না। নিজেই সাবান দিয়ে ডলে গোসল দিল। শরীর মুছে শুকনো কাপড় পরিয়ে ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দিল। ইমাম সাহেবের গায়ে জ্বর নেই। জ্বর ছাড়াই তিনি কাঁপছেন। আনিস বলল, আপনি রাতে কিছু খেয়েছেন?
ইমাম সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, জ্বি না।
আপনার খাবার কে রোধে দেয়?
আমি নিজে রান্ধি ডাক্তার সাব।
আমি আপনার জন্যে এক গ্লাস দুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে শুয়ে থাকুন। দুটা ট্যাবলেট পাঠাব। দুধ খাওয়ার পরে খাবেন। ঘুমের ওষুধ। ভালো ঘুম হবে।
ইমাম সাহেব কিছু বললেন না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন। ডাক্তার দ্রুত চিন্তা করছে–ঘুমের ওষুধ ছাড়াও কি আরো কিছু দেয়া দরকার। মানুষটার স্নায়ুর ওপর দিয়ে একটা ঝড়ের মতে গিয়েছে। উত্তেজিত স্নায়ু ঠিক করতে হলে কী সিডেটিভ দিতে হবে? মানুষটা একা থাকে। একজন কেউ সঙ্গে থাকলে ভালো হতো। কথাবার্তা বলতে পারত। মানুষের সঙ্গ মাঝে মাঝে ওষুধের চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর হয়।